ক্রীড়া ডেস্ক
অতন্দ্র প্রহরীরা যখন অতিমানব
প্রতি চার বছর পর পর যখন বিশ্বকাপ শুরু হয় তখন আলোচনাটা বেশি হয় ফরওয়ার্ডদের নিয়ে। তাছাড়া মিডফিল্ডারদের দিকেও চোখ থাকে অনেকের। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের কাছে বিপজ্জনক নাম তারা। কিন্তু প্রতিপক্ষের জন্য ত্রাসের আরেক নাম গোলরক্ষক। যিনি একা সেপাইয়ের মতো পাহারা দেন দৈর্ঘ্যে ৭.৩২ মিটার ও প্রস্থে ২.৪৪ মিটার লম্বা গোলপোস্ট। অথচ গোলরক্ষক কখনো হয়ে উঠেন না দলেন মধ্যমণি। তবে দলের দুঃসময়ে তার কাছে শরণাপন্ন হতে হয় সবাইকে। প্রতিপক্ষের বুলেট গতির শট, ফ্রি-কিক, স্পট কিক বা টাইব্রেকারের সময় একাই লড়ে যান প্রতিপক্ষের বিপক্ষে। কিন্তু যখন গোল হজম করেন, তখন সব দোষ তার ঘাড়েই বর্তায়। কিন্তু নির্বিকার চিত্তে গ্লাভস হাতে তিনি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত লড়াই করেন গোলপোস্ট অক্ষত রাখতে। বিশ্বকাপ শেষে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বরাদ্দ থাকে গোল্ডেন গ্লাভস পুরস্কারটি।
গত বিশ্বকাপে গোল্ডেন গ্লাভসের পুরস্কার উঠেছিল আসর চ্যাম্পিয়ন জার্মানির গোলরক্ষক ম্যানুয়েল ন্যুয়ারের হাতে। ২০১০ বিশ্বকাপের সেরা হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন স্পেনের গোল ইকার ক্যাসিয়াস। এবারও হয়তো চ্যাম্পিয়ন দলের গোলরক্ষকের হাতেই উঠতে পারে গোল্ডেন গ্লাভসের পুরস্কারটি। এখন পর্যন্ত ৪ ম্যাচে ২৫টি সেভ করে শীর্ষে আছেন মেক্সিকোর গোলরক্ষক গুইলার্মো ওচোয়া। কিন্তু ব্রাজিলের বিপক্ষে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হয়ে গেছে তার। ২১টি বল ঠেকিয়ে ওচোয়ার নিচে আছেন ডেনমার্কের গোলরক্ষক কাসপার স্কেমেল। অথচ তিনিও থেমে গেছেন শেষ ষোলোতে। তবে স্বপ্নটা টিকে আছে বেলজিয়ামের গোলরক্ষক থিবু কোর্তোয়ার।
কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে পরাস্ত করার পেছনে মূল কাজটাই করেছেন এই চেলসি গোলরক্ষক। বেলজিয়ামের গোলমুখে রেকর্ড ২৭টি শট নিয়েছিল সেলেকাওরা। এখন পর্যন্ত ৫ ম্যাচে ১৮টি বল ঠেকিয়েছেন তিনি। সামনে পাচ্ছেন আরেকটি ম্যাচ। সেমিফাইনালে সুযোগ থাকছে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। ফাইনালে উঠতে পারলে হয় সোনার গ্লাভসটা জিততেও পারেন কোর্তোয়া। নেইমার-কুতিনহোদের যেভাবে গোলবঞ্চিত করেছেন, পুরস্কারটা হয়তো তার হাতে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। প্রতিপক্ষ মাত্র পাঁচবার তাকে ফাঁকি দিতে পেরেছে।
রাশিয়া বিশ্বকাপে সবচেয়ে চমক হয়ে থাকবেন ইগর আকিনফিভ। স্বাগতিক রাশিয়ার অধিনায়ক ও গোলপোস্টের প্রধান ভরসা তিনি। রাশিয়ার রূপকথা লেখার মূল ভূমিকাটা পালন করেছেন তিনি। টাইব্রেকারে স্পেনের দুইটি শট রুখে দিয়ে দলকে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে তুলেছেন আকিনফিভ। তাকে তুলনা করা হচ্ছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কিংবদন্তি গোলরক্ষক লেভ ইয়াসিনের সঙ্গে। কিন্তু শেষ চারে উঠার লড়াইটা দুঃস্বপ্ন হয়েই থাকবে তার। টাইব্রেকারে লুকা মডরিচের নেওয়া স্পট কিকটি প্রায় ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য হয়তো এইদিন ছিলেন না আকিনফিভের সঙ্গে। ৫ ম্যাচে ১৫টি বল ঠেকিয়েছেন তিনি।
এই বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠার লড়াইয়ে টিকে আছে চার দল। তাতে থিবু কোর্তোয়ার পরেই আছেন ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক ডানিজেল সুভেচিচ। রাশিয়া বিশ্বকাপে নকআউট পর্বে টানা দুইবার টাইব্রেকারের মুখোমুখি হয়েছেন এই গোলরক্ষক। দুইবারই ক্রোয়াটদের জয়োল্লাস এনে দিয়েছেন সুভেচিচ। রাশিয়ার বিপক্ষে উরুতে চোট পেলেও মডরিচ-রাকিটিচদের বাঁচিয়েছেন তিনি। ৭ নম্বরে থাকা সুভেচিচ পাঁচ ম্যাচে সেভ করেছেন ১২টি। অন্যদিকে সমান ম্যাচে ১৪ নম্বরে থাকা জর্ডান পিকফোর্ডকে কাজটি করতে হয়েছে ১০ বার। আরেক সেমিফাইনালিস্ট ফ্রান্সের গোলরক্ষক হুগো লরিস ৮টি সেভ করে আছেন ২০ নম্বরে। লরিসকে অগ্নিপরীক্ষায় পড়তে হয়নি ফরাসিদের রক্ষণভাগের কারণে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের অন্যতম গোলরক্ষক ডেভিড ডি গিয়াকে বল ঠেকাতে হয়েছে মাত্র একটি। কিন্তু এই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড গোলরক্ষকের স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেছে দ্বিতীয় রাউন্ডেই। দলের রক্ষণভাগের কারণে অনেকে হয়তো বিশ্বসেরা গোলরক্ষকদের পড়তে হয়নি কঠিন পরীক্ষায়। তবে এই বিশ্বকাপে নাম কুড়ানোর পাশাপাশি অনেক গোলরক্ষককে কুড়াতে হয়েছে বদনামও। তার মধ্যে এগিয়ে আছেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক উইলফ্রেডো কাবেয়ারো। গ্রুপ পর্বে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে দুইটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন তিনি। যার ফলে ৩টি গোল হজম করতে হয় মেসি-আগুয়েরোদের। পরবর্তী ম্যাচটা তাই দলের বাইরে চলে যেতে হয় এই ৩৬ বছর বয়সী গোলরক্ষককে। তার পরিবর্তে হোর্হে সাম্পাওলি গোলপোস্টের দায়িত্ব দেন ফ্রাঙ্কো আরমানি।
রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলতে নেমেই একটি রেকর্ড নিজের করে নেন মিসরের গোলরক্ষক এসাম আল হাদারি। ৪৫ বছর বয়সী মিসরীয়ই এখন বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি বয়সী গোলরক্ষক। তাছাড়া কেইলর নাভাস, ডেভিড ওসপিনা, রবিন ওলসেন ও অ্যালিসনরাও গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে বারবার হতাশ করেছেন প্রতিপক্ষদের। কিন্তু তাদের বিশ্বকাপ অভিযানটা শেষ হয়ে গেছে আগেই।
"