ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

সন্দেহ স্থানীয় সমাজসেবা অফিসের লোক জড়িত 

ভাতাভোগীর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র 

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার হতদরিদ্র সুবিধাভোগী মানুষের ব্যক্তিগত ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টে আসা সরকারি ভাতাভোগীদের টাকা মোবাইলে আসার সঙ্গে সঙ্গে হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারক চক্র। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে ভুক্তভোগীদের মাঝে মিশ্র পতিক্রয়া। তবে এই প্রতারক চক্রের সাথে সমাজসেবা অফিসের লোকজন জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধি,স্বামী পরিত্যক্ত ও শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা ভাতাভোগীদের একাউন্টে আসা মাত্রই মিনিটের মধ্যে সুকৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্রটি।

সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় বয়স্কভাতা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৩৩৮ জন। বিধবাভাতা পাচ্ছে ৯ হাজার ৪০৯ জন, প্রতিবন্ধি ভাতা প্রাপ্তির সংখ্যা ৯ হাজার ৮৫৬জন, বেদে-৩৯, হিজড়া-৪, প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির সংখ্যা ২১৬ এবং অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি পাচ্ছেন ৩৪ জন।

জানা যায়, তার মধ্যে বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও শিক্ষা উপবৃত্তি ভাতার ত্রৈমাসিক কিস্তির টাকা ছাড়করণ শুরুর খবর জেনে সক্রিয় হয়ে উঠে প্রতারক চক্রটি। সমাজসেবা অফিসের নাম ভাঙিয়ে কল করে ভাতাভোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে টাকা ও মোবাইল অ্যাকাউন্টের পিন নম্বর। ইতোমধ্যে অনেক ভাতাভোগীকে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে নগদ নম্বরে এসএমএস পাঠিয়ে টাকাসহ গোপন পিন নম্বর নিয়ে গেছে প্রতারক চক্রটি।

ভুক্তভোগীরা বলছেন টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ সমাজসেবা কার্যালয়ে এসে জানালেও মিলছে না কোন সমাধান। এ বিষয়ে সমাজসেবা অফিস বলছে কোন ভুক্তভোগীই লিখিত কোন অভিযোগ করেননি।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, সমাজসেবা অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও নগদের সাথে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজেশে চলছে এমন প্রতারণা। তারা বলেন, কর্মকর্তারা জড়িত না থাকলে আমাদের নাম ঠিকানা ও ভাতা দেওয়ার তারিখ ও সময় প্রতারক চক্র কিভাবে জানে। প্রতারণার শিকার কয়েকজন ভাতাভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাতা দেওয়ার সময় সমাজসেবা অধিদপ্তর ও নগদ অফিসের কর্মকর্তা পরিচয়ে ফোন করে বলেন, আপনার ভাতার টাকা মোবাইল একাউন্টে পাঠানো হবে অথবা আপনার তথ্য আপডেড করতে হবে অথবা আপনাকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে দয়া করে আপনার মোবাইলে প্রেরিত কোড (ওটিপি) নম্বরটি বলেন। নাম্বার বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা নগদ একাউন্টের একসেজ তাদের হাতে নিয়ে নিচ্ছে পরে নগদে টাকা আসার সাথে সাথে টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের ভাটিচড়নওপাড়া গ্রামের বয়স্ক ভাতাভোগী শামছদ্দিনকে ০৯৬৩৮১৯৫৩২২ নম্বর থেকে ফোন করে বলে আপনার নাম্বারটি অনলাইন হয়নি, আমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন না হলে আপনার ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর কথার প্যাচে ফেলে নিয়ে নেয় মোবাইলের গোপন পিন নম্বর। তারপরই নগদ আসা ভাতার ১৮শ টাকা নাই।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের দড়ি পাঁচাশি গ্রামের বয়স্ক ভাতাভোগী হাছেন আলীর মোবাইল ফোনে ৭ফেব্রুয়ারি বিকেলে একটা কল আসে। উপজেলা সমাজসেবা অফিসের স্টাফ পরিচয় দিয়ে তাঁকে জানানো হয়, আপনাকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। তাই দয়া করে আপনার মোবাইলে প্রেরিত কোড (ওটিপি) নম্বরটি বলেন। নাম্বারটি বলার সাথে সাথে সংযোগটি কেটে দেয়। বিষয়টি সমাজসেবা অফিসকে অবহিত করলে তারা জানান এটি প্রতারক চক্রের কাজ। পরে তিনি নগদ একাউন্ট অফিসে ফোন করে বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করেন।

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের চরহোসেনপুর গ্রামের বিধবা জমিলা বেগম কে সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কল দিয়ে ফোনে জরুরি তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে বলেন, না হলে এখনি উপজেলা সমাজসেবা অফিসে আসতে হবে। তিনি ভাবলেন, বিষয়টা যখন জরুরী সমাজসেবা অফিসে যাওয়ার চেয়ে বিকল্প পদ্ধতিটাই উত্তম। তাই তিনি সরল বিশ্বাসে বিকল্প অপশনেই রাজি হলেন এবং তাঁর মোবাইলের মেসেজে আসা কোড নম্বরটি জানিয়ে দিলেন কলারকে। এরপরে তাঁকে জানানো হয় তাঁর তথ্য আপডেট হয়েছে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মোবাইলে ভাতার টাকা চলে যাবে। এরপরে তাঁর ব্যালান্স চেক করতে গিয়ে দেখেন অ্যাকাউন্ট শূন্য।

এসব অভিযোগ পাওয়ার পরে রোববার দুটি নম্বরে কল করা হলে রিসিভ করে সঙ্গে সঙ্গে লাইনটি কেটে নম্বরটি বন্ধ করে দেয়। তারপর বহুবার ওই দুটি নম্বরে কল দেওয়া হয় কিন্তু নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. হাসান কিবরিয়া এ ব্যাপারে বলেন, সমাজসেবা অফিস থেকে কখনোই কাউকে ফোন করা হয় না। এগুলো প্রতারক চক্রের কারসাজি। তারা নানান কৌশলে আগে ভাতাভোগীদের তথ্য সংগ্রহ করে। এরপরে তাদের ফোন করে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিয়ে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে গোপন পিন নম্বর সংগ্রহ করে ওই টাকা হাতিয়ে নেয়। বর্তমানে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ত্রৈমাসিক কিস্তির টাকা ছাড়করণ শুরু হয়েছে। এই খবর পেয়েই হয়তো সক্রিয় হয়ে উঠেছে প্রতারক চক্র। তাই পরিচয় যা-ই দিক না কেন মোবাইল ফোনে কখনোই কাউকে কোনো তথ্য, কোড কিংবা পিন নম্বর দিতে নিষেধ করেন তিনি। এ উপজেলায় ভাতার প্রতারণার বিষয়টি তিনি শুনেছেন তবে এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। যদি কেউ প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন তাহলে তাকে থানায় জিডি করে তাদের কাছে জানালে তিনি বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষে অবহিত করবেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফুল ইসলাম প্রিন্স এ বিষয়ে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা সভায় গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। মোবাইল ফোনে কখনোই কাউকে কোনো তথ্য, কোড কিংবা পিন নম্বর দিতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপরও কেউ এ ধরণের প্রতারণার শিকার হলে ভাতাভোগীকে জিডি করতে বলা হয়েছে। ভাতাভোগীদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে সমাজসেবা অফিসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ময়মনসিংহ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close