খালেকুজ্জামান পান্নু, পাবনা

  ২৬ নভেম্বর, ২০২২

আজ ধুলাউড়ি গণহত্যা দিবস

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

আজ ২৭ নভেম্বর। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধুলাউড়ি গণহত্যাযজ্ঞের দিন। সারাদেশে চলছিল মুক্তিযুদ্ধ। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা এসে অবস্থান নিয়েছিলেন সাঁথিয়া থানার ধুলাউড়ি গ্রামে। একই গ্রামে সকলের অবস্থান করা নিরাপদ নয় ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা ভাগাভাগি করে পার্শ্ববর্তী বিলসলঙ্গী, রামকান্তপুর, পাইকশা, নাড়িয়াগদাই গ্রামে রাতযাপনের ব্যবস্থা করেন।

দীর্ঘ কয়েক মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে একটানা যুদ্ধ করে সবাই ক্লান্ত ছিলেন। সাঁথিয়া থানা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে জায়গাটি তাদের ধারণায় কিছুটা নিরাপদ মনে হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাত পোহালে পরবর্তী আক্রমণের জন্য সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নেবেন। এদিকে কিছুদিন আগে (১৯৭১, সেপ্টেম্বর মাসে) মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া হাইস্কুলে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করে নয়জন রাজাকারকে হত্যা করেন এবং অস্ত্রলুট করে নেন। মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক রাজাকার হত্যা ও অস্ত্র লুট হওয়ায় পাক সেনারাও নজর রাখছিল।

২৭ নভেম্বর রাত আনুমানিক ৩টা। চারদিকে গা ছমছম করা থমথমে ভাব। দূরে কুকুরের করুণ সুরের গোংরানি যেন অশুভ ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ গুলির শব্দ। রাজাকারদের সহায়তায় ৫০০ পাক সেনারা কৌশলে ধুলাউড়ি গ্রাম ঘিরে ফেলে। পার্শ্ববর্তী বেড়া থানার জোড়দহ গ্রামের আসাদ নামে এক রাজাকার ছিল এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পথপ্রদর্শক। ডিউটিরত মুক্তিযোদ্ধারা সময়মতো তাদের সহযোদ্ধা বা গ্রামবাসীকে সতর্ক করার কোনো সুযোগ পাননি। ভোর রাত থেকে শুরু হয় পাক সেনাদের তাণ্ডবলীলা। একাধারে চলতে থাকে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারা ও ঘুমন্ত গ্রামবাসী হতবিহবল হয়ে প্রাণভয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। পাক সেনারা বাড়ি বাড়ি থেকে মেয়েদের ধরে ধর্ষণ করে পার্শ¦বর্তী খালে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা ও বহু গ্রামবাসীকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে ঘুমন্ত অবস্থায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। রশি দিয়ে একত্রে বেঁধে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে এসে ব্রাশ ফায়ারে নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। ওইদিনের হত্যাযজ্ঞে আটজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৯ জন গ্রামবাসীর লাশ সনাক্ত করা হয়েছিল।

তারা হলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খবির উদ্দিন, আখতার হোসেন, দ্বারা হোসেন, চাঁদ বিশ্বাস, মহসীন আলী, শাহজাহান আলী, মকছেদ আলী ও মুসলিম উদ্দিন। হত্যার শিকার গ্রামবাসীরা হলেন আবুল কাশেম ফকির, ডা. আব্দুল আওয়াল, জহুরুল ইসলাম ফকির, আব্দুর রশিদ ফকির, আব্দুল গফুর, আব্দুস সামাদ, নইম উদ্দিন খলিফা, ওয়াজেদ আলী, কোবাদ বিশ্বাস, আখতার হোসেন তালুকদার প্রমুখ।

সে দিন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের গায়ের চাঁদর দিয়ে জড়িয়ে কোনোমতে ধুলাউড়ি ফকিরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাফন করা হয়। সেখানে আরও রাখা হয় ব্রাশ ফায়ারে নিহত ১০-১১ জন গ্রামবাসীকে। সেটি এখন গণকবর হিসেবে পরিচিত।

ধুলাউড়ির সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞ এখনো সাঁথিয়াবাসীর কাছে দুঃখ ও বেদনার স্মৃতি হয়ে আছে। বর্তমানে সেখানে শহীদদের স¥রণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দিবসটি যথাযথভাবে পালনের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ধুলাউড়ি,গণহত্যা,সাঁথিয়া
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close