reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪

কাজ হচ্ছে না অভিযানেও

নমনীয় আইন প্রয়োগে বেপরোয়া ব্যবসায়ীরা

ছবি কোলাজ : প্রতিদিনের সংবাদ

চলতি বছরের শুরু থেকেই অস্থিরতা লেগে আছে দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য চালের বাজারে। মন্ত্রী-সচিবদের হুমকি-ধমকি এবং মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অভিযানসহ সরকারের নানা পদক্ষেপেও স্বস্তি ফিরছে না। অভিযানের পর পাইকারি চালের বাজারে তাৎক্ষণিক নামমাত্র দাম কমলেও এর প্রভাব নেই খুচরা বাজারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু ভয় দেখালে হবে না, আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, মোটা চাল (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০-৫৩ টাকায়। মাঝারি মানের চাল (পাইজাম ও বিআর ২৮) ৫২-৫৭ টাকা এবং সরু চাল (মিনিকেট ও নাজিরশাইল) ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে কিছু হাস্কিং মিলের মোটা চাল ৪২-৪৫ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে। অথচ চলতি জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকেও এসব চালের দাম প্রতি কেজিতে ১০ টাকা কমে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে জোরেসোরেই মাঠে নেমেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। চালের অবৈধ মজুত প্রতিরোধে নিয়মিত মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সোমবার (২৯ জানুয়ারি) সারাদেশে কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। মাগুরা জেলায় ৩৭টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় ফুডগ্রেইন লাইসেন্স না থাকায় ৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জয়পুরহাটে ৪৩টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়। অতিরিক্ত মজুত রাখায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া দিনাজপুরে ৬২টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফুডগ্রেইন লাইসেন্স না থাকায় চার হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। নেত্রকোণায় ২২টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়। এসময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মূল্যতালিকা ও ফুডগ্রেইন লাইসেন্স না থাকায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মাঠে কাজ করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। দাম নিয়ন্ত্রণে নিজেই সরাসরি বাজারে যাচ্ছেন অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান। সম্প্রতি অভিযান পরিচালনার সময় তিনি বলেন, সরকারকে বিব্রত অবস্থায় ফেলতেই অযৌক্তিকভাবে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। ডিসেম্বরের পর হঠাৎ চালের দাম বেড়ে গেছে। এটি উত্তরাঞ্চলের মিলগুলো থেকে করা হয়েছে। মিল মালিকরা বলতে চাচ্ছেন ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা এটা করেছে। তবে ধানের দাম বাড়লেও সেই ধানের চাল বাজারে আসার কথা বৈশাখ মাসে। একটি অসাধু চক্র এর আগেই দাম বাড়িয়েছে। আর যারা এটা করছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর আগে শনিবার (২৭ জানুয়ারি) বরিশালের ফরিয়াপট্টি, চকবাজার এলাকার পাইকারি বাজার পরিদর্শন করেন এ এইচ এম শফিকুজ্জামান। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় তিনি বলেন, এসএমএসের (ক্ষুদে বার্তা) মাধ্যমে ডিম, ব্রয়লার মুরগির মতো চালের বাজারও অস্থির করে দেওয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে সুযোগ নিয়ে ১৭ কোটি ভোক্তাকে প্রতারিত করছে ক্ষুদ্র কয়েকটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। এর আগে আলু, ব্রয়লার মুরগি, ডিম নিয়ে যা করছে আজ চাল, কাল পেঁয়াজ নিয়েও তা করা হচ্ছে। আর এদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান রয়েছে আমাদের।

এদিকে না শোধরালে মজুতদারদের জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। রোববার নওগাঁয় এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, দেশে খাদ্য শস্যের কোনো ঘাটতি নেই। সাধারণ মানুষের জন্য সরকারিভাবে ওএমএস চালু আছে। ডিজিটাল কার্ড প্রস্তুত হয়েছে। শিগগিরই ডিজিটাল কার্ডের মাধ্যমে ওএমএস বিতরণ করা হবে। এতে এক ব্যক্তি বারবার চাল নিতে পারবেন না। চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে হলে ব্যবসায়ীদের অধিক লাভের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে মিলার, পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ী ও করপোরেট— সবার দায় রয়েছে। ফুডগ্রেইন লাইসেন্স স্পটে গিয়ে দেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। অনেকেই আবার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটা লাইসেন্স নিয়ে কোটি কোটি টাকার পণ্য মজুত করে ফেলেন। এটা তো হতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন ২০২৩ পাস হয়েছে। বিধি প্রণয়নের কাজ চলছে। এটি সংসদে অনুমোদন পেলে অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে আরও শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। শুধু জরিমানা করেই ছাড় নয়, অবৈধ মজুতদারেরা না শোধরালে তাদের জেলে যেতে হবে।

চালের মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে বাজারে সরবরাহের কোনো সংকট নেই জানিয়ে খাদ্যসচিব ইসমাইল হোসেন বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য। না আসার কোনো কারণ নেই। সারাদেশে খাদ্যের কোনো সংকট নেই। আমন মৌসুম শেষ হলো। সুতরাং ভরা মৌসুমে চালের সংকট নেই। খাদ্যের সংকট হবে— এমনটিও ভাবার কোনো কারণ নেই। যদি পরিস্থিতি এমন হয় মজুতদারেরা মূল্য কমাতে চাচ্ছে না, তাহলে জিরো ট্যাক্স করে আমরা বিদেশ থেকে চাল আমদানির অনুমতি নিয়ে নেব। তাহলে মজুতদারেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অপরদিকে, বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের লাগাম টানতে হবে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস চেয়ারম্যান এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এখনও চালের বাজারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। এখন খাদ্য মন্ত্রণালয় যে অভিযান চালাচ্ছে তার কোনো ইম্পেক্ট খুচরা বাজারে নাই। তারা যে পরিসরে অভিযান পরিচালনা করছে তা খুবই নগণ্য।

তিনি আরও বলেন, আমরা সরকার দুইটা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছি। একটা হচ্ছে— এই অভিযানটা খাদ্য মন্ত্রণালয় একা না করে জেলা প্রশাসক, ভোক্তা অধিদফতরসহ যেসব সংস্থা আছে তাদেরকে নিয়ে সমন্বিতভাবে যদি এটা করতো তাহলে এটার ফলোআপ থাকত। এখন মন্ত্রণালয় থেকে যেখানে যাচ্ছে পরবর্তীতে সেখানে আর কোনো ফলোআপ নাই। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীদেরকে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং আইনে যে বিষয়গুলো বলা আছে তার কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে আইন প্রয়োগ হয় নাই। যার কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে গেছে। এখন যে হাঁকডাক দেওয়া হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা তো জানে এই হাঁকডাক দুই-চার দিন থাকবে, তারপর আবার স্বাভাবিক। এজন্য আর হাঁকডাক না দিয়ে যদি অ্যাকশনে যাওয়া যায় তবে এর সুফল পাওয়া যাবে।

পিডিএস/এমএইউ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চাল,ডাল,নিত্যপণ্য,বাজার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close