আরিফ মঈনুদ্দীন

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব ৫)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

ড্রইংরুমে লিলিয়ান লীরার সঙ্গে কী কী যেন আলাপ করছে। মিসেস রাশেদা আক্তার মেয়েকে ডাকলেন।

লীরা ‘এক্সকিউজ মি’ বলেই অকস্মাৎ কথা শোনায় ছেদ টেনে মায়ের ডাকে সাড়া দিল। লিলিয়ান অপ্রত্যাশিত অসৌজন্যে খানিকটা ক্ষুব্ধ হলো। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সে বুঝতে পারছে এরা তার শারীরিক ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না।

রাশেদা আক্তার নিজের শোয়ারঘরের বিছানায় অর্ধ-শোয়া অবস্থায় থেকে এসব ভেবে চলেছেন। এত কিছুর পরেও নিজের মেয়েটি এরকম একটি বখাটে মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল! ভাবনায় তার পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে।

লীরা মার কক্ষে ঢুকে বলল, মা তুমি কেন ডাকছ?

তুমি এখনো বুঝোনি কেন ডেকেছি? রাশেদা আক্তারের কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা। তিনি বললেন, আপদটাকে বিদেয় করে তবে এসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

লীরা ব্যাপারটা বুঝেছে। মাকে তো সে খুব ভালোভাবেই জানে। আর এ জানাজানিটা বেশি পোক্ত হওয়ার কারণ হলো মায়ের সঙ্গে তার নিখাদ বন্ধুত্ব। এখানকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারে ওর মা এ পর্যন্ত যত উপদেশ দিয়েছেন এবং যত নিয়মনীতি শিখিয়েছেন, তা লিপিবদ্ধ করলে কয়েক খণ্ডের একটি নীতিশাস্ত্র লেখা হয়ে যাবে। মা ভাবছেন তার সব উপদেশ ভেস্তে গেছে। আমি এরকম একটি মেয়ের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখলাম?

লীরা এবার ড্রইংরুমে এসে দেখে লিলিয়ান একটি সাপ্তাহিকীর পাতা ওল্টাচ্ছে। ভাবখানা এমন- ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিন ঘেঁটে কথাবার্তা বলে সময় পার করছে। এখানে লাঞ্চটা সেরেই তবে যাবে। লীরা মনে মনে বলে, লাঞ্চের গোষ্ঠী মারি। এখনই মাগিটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করব।

লীরা বলল, আচ্ছা লিলিয়ান তুমি কি বসবে? আমাকে মায়ের সেবা করতে হবে। মা হঠাৎ কীসব চিন্তা করতে করতে ঘেমে নেয়ে উঠছেন। তার আবার মন খারাপ হলে সঙ্গে সঙ্গে শরীরটাও খারাপ হতে থাকে; সুতরাং তোমাকে সময় দেওয়া যাচ্ছে না।

লিলিয়ানও এদের অ্যাটেনশানের ধরন-ধারণ দেখে বুঝেছে এখানে আর বেশিক্ষণ থাকাটা মর্যাদাহানিকর; সুতরাং উঠতে হবে।

লীরা দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে মায়ের কক্ষে ঢোকামাত্র রাশেদা আক্তার ঠাণ্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলেন, ওই বাজে মেয়েটি কি বিদায় হয়েছে? লীরা।

জি মা চলে গেছে।

কেন থাকতে বলিসনি? দুপুরে খেয়ে যেত।

রাশেদা আক্তার মেয়ের মানসিকতা পরীক্ষা করার জন্য ইচ্ছেমতো কণ্ঠকে নিম্নগ্রামে নামিয়ে রেখে কথা বলছেন। মনে মনে তৈরি হচ্ছেন, আচ্ছা করে একটা বকুনি লাগাবেন।

লীরা মায়ের সব ধরনের ট্রিটমেন্টের সঙ্গে পরিচিত। সে বুঝে ফেলেছে- মা কী বোঝাতে চাচ্ছেন। লীরা বলল, কী বলছ মা। ওকে সেধে রাখব আমি? ওকি আমার বান্ধবী যে তাকে যত্ন-আত্তি করে খাওয়াতে হবে। তা ছাড়া এ মেয়ের বয়স বোঝোনি? ও কম করে হলেও আমার চার বছরের ছোট হবে। এখনো ‘ও’ লেভেল শেষ করেনি।

রাশেদা আক্তার বললেন, এখানের বন্ধুত্বে সিনিয়র-জুনিয়র কোনো ব্যাপার না, তুমি অন্য প্রসঙ্গে বলো।

মায়ের গলার স্বর ক্রমশ উচ্চগ্রামে উঠছে। কথার ঝাঁজে টের পাচ্ছে লীরা। এখন উপায়? মা একবার গরম হলে থামানো কিন্তু মুশকিল। সে ভাবে উপায় একটা আছে। আগে মায়ের এক্কেবারে পাশে গিয়ে বসতে হবে। রাশেদা আক্তারও জানে যখন মেয়ের দোষ কিছু থাকে তখন সে মায়ের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলে। আর যখন দোষ নেই বলে প্রচণ্ড মনোবল থাকে তখন মায়ের পাশে গিয়ে গায়ে হাত রেখে শিশুসুলভ আচরণ করে। লীরা মায়ের পিঠে হাত রেখে দেখল বেশ ঘেমে উঠেছেন তিনি। তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে লীরা বলল, মা তুমি ব্যাপারটা আগে আমার কাছ থেকে জানবে তো। তারপর না-হয় আমাকে আচ্ছামতো শায়েস্তা করতে হয়, করবে। আমি তোমার কেমন মেয়ে তা তো তুমি জানো। যেমন আমি জানি তোমাকে। আমি কি ওরকম দুশ্চরিত্রা একটি মেয়ের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিফ করতে পারি!

যা বলার তুই সরাসরি বল। আমি আর ধৈর্য রাখতে পারছি না।

মা, অধৈর্য হওয়ার তেমন কিছুই নেই। তুমি একশ পার্সেন্ট নিশ্চিত হতে পারো- ও মেয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব নেই। কোনো যোগাযোগও কখনো ছিল না। তোমার কি মনে নেই? আমাদের কলেজে ওইদিন অনুষ্ঠানের শেষের দিকে সে তার নোটবইটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল ঠিকানাটা লিখে দিতে। আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধু সৌজন্যের খাতিরে নোটবইটা হাত বাড়িয়ে নিয়েছিলাম। ঠিকানাটা লিখে দেওয়ার পর থেকে আর কখনো ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। সে তোমাকেই তো বলেছিল এপথ দিয়ে যাচ্ছিল ঠিকানাটা মনে পড়ার পর বাসায় উঠে গেল।

মেয়ের কথায় রাশেদা আক্তারের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। বিশেষ করে লীরার বলার ঢঙে কোনোই কৃত্রিমতা ছিল না। এটা মা হয়ে টের পেতে তার কষ্ট হয়নি। রাশেদা আক্তারের চোখ টলটল করছে। তিনি আনন্দে কেঁদে ফেলবেন মনে হচ্ছে। আজও তার জিত হলো। মেয়ে তার বিপথগামী হয়নি। তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কপোলে চুমু খেলেন। আবেগে তার চোখ থেকে এবার সত্যিই সত্যিই জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। বিজয়ের আনন্দে তার বেশি করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। লীরাও মায়ের স্নেহ-বন্ধনের দৃঢ়তায় অশ্রু সামলাতে পারল না। রাশেদা আক্তার বললেন, দেখ মা ফ্রিজে ঠাণ্ডা কোমল পানীয় আছে। এই ভরদুপুরে ওর স্বাদই আলাদা কিছু ফ্রুটস্ও আছে- যা এখনই খেতে হয় এবং ঠাণ্ডা দই-মিষ্টিও রেখে দিয়েছি, কিন্তু পোড়ামুখী না হয়ে যদি আমার মনের মতো তোর কোনো বান্ধবী আসত, আমি সব দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করতাম। কিন্তু লিলিয়ান না ফিলিয়ান এই বজ্জাত মেয়েটির জন্য আমার হাত এগোয়নি একটুও।

ঠিক করেছ মা, এদেরকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। একসময় দেখবে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে হাজির হয়েছে। তারচেয়ে বরং এভাবে এড়িয়ে গেলেই ভালো। আর আমাকে নিয়ে তুমি কোনোই চিন্তা করবে না। আমার নষ্ট হওয়ার দুর্বিনীত সময়টাকে বন্ধুর গিরিপথে অশ্ব দাবড়ানোর মতোই ডিঙিয়ে এসেছি। বলতে পারো তোমার মেয়ে শুধু ভালো নয়। পরীক্ষিত ভালো।

মেয়ের কথা শুনতে রাশেদা আক্তারের ভালো লাগছে। বাবা-মায়েরা এ বয়সের ছেলেমেয়েদের মুখে ইতিবাচক কথাবার্তা শুনলে আনন্দে কুলকুল করতে থাকেন। রাশেদা আক্তার মনে যেন মেঘনা নদী কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে চলছে। মেয়েকে এভাবে ধরে রাখার পেছনে তারা স্বামী-স্ত্রীতে মিলে পরিকল্পনামাফিক সংসারকে এগিয়ে নিয়েছেন। এ বিদেশবিভুঁইয়ে বিশেষ করে সার্বক্ষণিক দেহজগতের প্রতিকূল পরিবেশে চরিত্র ধরে রাখা সাংঘাতিক সংযমের ব্যাপার। টিনএজের মেয়েরা এ রকম খোলামেলা পরিবেশে সংযম নামক পারলৌকিক বাণীতে মুগ্ধ হবে কোন দুঃখে? যদি না তাদের নিজ নিজ পরিবারে পাপবোধের চাষাবাদ হয়।

রাশেদা আক্তার চিন্তা করে দেখেছেন, শরীরবৃত্তিয় এ চাহিদার অনুকূলে যদি পরিবেশ খোলামেলা থাকে তাহলে তারুণ্যকে এ থেকে বাধা দেওয়া অনেক সময় বুমেরাং হয়ে যায়। এখানের অনেক প্রবাসী বাঙালি পরিবারের খবর তার জানা আছে। ছেলেমেয়েদের চরিত্র গঠনে ভালো থাকা, ভালো শিক্ষা এবং সর্বোচ্চ নৈতিক উন্নতি সাধনে উত্তম সাথি সঙ্গের ভূমিকা যেমন প্রণিধানযোগ্য, ঠিক বিপরীতভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্যও এই সাথি সঙ্গই দায়ী। এ প্রসঙ্গে বাল্যকালের সেই নীতিবাক্য বারবার মনে পড়ে। ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। সুতরাং রাশেদা আক্তারের ধারণা হলো, উত্তম পারিবারিক পারিবেশ বজায় রেখে পরিবারভুক্ত সবার গ্রহণযোগ্য মাত্রায় শান্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রাত্যহিক জীবনের ওই দিকটার প্রতি উদাসীনতা কমাতে হবে। কমাতে হবে ঠিক একথা বললে কম বলা হয় উদাসীন- থাকাই যাবে না। পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানীরা দেরিতে হলেও পারিবারিক জীবনের সুফলটা এবার বুঝেছে। এখন তো পুরো ইউরোপব্যাপী বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক সংস্থার একটিই স্লোগান ‘সবাই পরিবারে ফিরে এসো, শান্তি ধ্বংসের এই যজ্ঞোৎসব বন্ধ করো।’ পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানীরা উন্নততর গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা খুঁজছেন। কীভাবে ঘরছাড়া ইউরোপবাসীকে পরিবারের স্বাদ পাইয়ে দেওয়া যায়? তারা গবেষণাগারে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। দেখা যাচ্ছে, প্রাচ্যের সুন্দর পারিবারিক জীবনে কী অনাবিল শান্তি। সুখের চাষাবাদ করার জন্য এটাই হওয়া উচিত প্রথম সোপান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close