অনুবাদ : মুম রহমান

  ১২ অক্টোবর, ২০১৮

আইজাক এসিমভের গল্প

সত্যিকারের প্রেম

আমার নাম জো। আমার সহকর্মী মিলটন ডেভিডসন আমাকে এ নামেই ডাকেন। তিনি একজন প্রোগ্রামার এবং আমি একটি কম্পিউটার পোগ্রাম। আমি মালটিভাক-কমপ্লেক্সের একটা অংশ এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সংযুক্ত। আমি সব কিছুই জানি। একদম সব কিছুই।

আমি মিলটনের ব্যক্তিগত গ্রোগ্রাম। তার একান্ত জো। বিশ্বের যে কারো চেয়ে তিনি প্রোগ্রামিং ভালের বোঝেন, আর আমি তারই তৈরি একটি নিরীক্ষামূলক প্রোগ্রাম। তিনি আমাকে অন্য যেকোনো কম্পিউটারের চেয়ে ভালভাবে কথা বলার মতো করে তৈরি করেছেন।

‘এটা কিছুই না। কেবল কিছু সংকেতকে ঠিক মতো উচ্চারণ করা, জো’ তিনি আমাকে বলেছেন। ‘এইভাবেই মানুষের মগজে এটা কাজ করে যদিও আমরা এখনো জানি না মগজে কোনো সংকেতগুলো আছে। আমি তোমার সংকেতগুলো জানি, তাই আমি একের পর এক তোমারগুলোকে মেলাতে পেরেছি।’ তাই আমি কথা বলতে পারি। অবশ্য আমার মনে হয় না আমি যত ভালোভাবে চিন্তা করতে পারি তত ভালোভাবে কথা বলতে পারি, কিন্তু মিলটন বলেন, ‘আমি বেশ ভালো কথা বলতে পারি।’ মিলটন এখনো বিয়ে করেননি, যদিও তার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘তিনি কখনোই যথার্থ নারীটি খুঁজে পাননি।’ একদিন তিনি বললেন, ‘জো, যদিও আমি তাকে খুঁজে পাইনি, তবু আমি সেরা জনকেই খুঁজে বের করব। আমি আমার সত্যিকার প্রেয়সীকেই খুঁজতে যাচ্ছি এবং তুমি আমাকে সাহায্য করতে যাচ্ছ। দুনিয়ার যত সমস্যা সমাধান করার জন্য তোমাকে উন্নততর করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এবার তুমি আমার সমস্যার সমাধান কর। আমার জন্য সত্যিকারের প্রেম খুঁজে দাও।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যিকারের প্রেম কী?’

‘সেটা বোঝার দরকার নেই। ব্যাপারটা এবস্ট্রাক্ট। তুমি শুধু আমাকে একজন আদর্শ মেয়ে খুঁজে দাও। তুমি মালটিভাক-কমপ্লেক্সের সঙ্গে সংযুক্ত, তাই তুমি চাইলেই পৃথিবীর যেকোনো মানুষ সম্পর্কেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। আমরা একের পর এক সবাইকে নানা শ্রেণি আর দল করে বাদ দিতে থাকব, শেষপর্যন্ত একজন মাত্র রয়ে যাবে। সেই হবে যথার্থ মানুষ। সেই হবে আমার।’

আমি বললাম, আমি তৈরি আছি।

তিনি বললেন, ‘প্রথমে সব পুরুষকে বাদ দাও।’

এটা খুব সহজ। তার কথা আমার পারমাণবিক ভাল্বে সংকেত সৃষ্টি করে। আমি পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে জড়োকৃত তথ্যভা-ারে পৌঁছতে পারি, সেখান থেকে আমি ৩,৭৮৪,৯৮২,৮৭৪ জন পুরুষকে বাদ দেই। আমি ৩,৭৮৬,১১২,০৯০ জন নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করি।

তিনি বললেন, ‘পঁচিশ বছরের নিচের সবাইকে বাদ দাও; চল্লিশের ওপরের সবাইকেও। এরপর ১২০-এর নিচের আইকিউ যাদের তাদের বাদ দাও; ১৫০ সেন্টিমিটারের নিচের এবং ১৭৫ সেন্টিমিটার ওপরের উ"চতার সবাইকেও বাদ দাও।’

তিনি আমাকে হুবহু মাপকাঠি তৈরি করে দেন; সন্তান জীবিত আছে এমন নারীদের তিনি বাদ দেন, বিচিত্র জেনিটিকস চরিত্র যাদের তাদেরকেও তিনি বাদ দেন। ‘চোখের রঙের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই,’ তিনি বলেন, ‘আপাতত এটা নিয়ে চিন্তা কর না, তবে লাল চুল বাদ। আমি লাল পছন্দ করি না।’

দুই সপ্তাহ পরে আমাদের তালিকা ২৩৫ জন নারীতে নেমে আসে। এরা সবাই খুব ভালো ইংরেজি বলে। মিলটন বলেন, তিনি ভাষাগত কোনো সমস্যা চান না। এমনকি কম্পিউটার-অনুবাদকও অন্তরঙ্গ মুহূর্তে কাজে লাগে না।

‘আমি ২৩৫ জনের সাক্ষাৎকার নিতে পারব না, তিনি বলেন, ‘এতে অনেক সময় যাবে, তাছাড়া সবাই আমার উদ্দেশ্য জেনে যাবে।’

‘তাতে সমস্যা হবে,’ আমি বললাম। আমাকে যে কাজের জন্যে ডিজাইন করা হয়েছিল মিলটন আমাকে তার চেয়েও বেশি কিছু দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে অন্য কেউ জানে না।

‘এটা তাদের জানার দরকার নেই,’ তিনি বলেন, এবং তার মুখের চামড়া রক্তিম হয়ে ওঠে। ‘আমি তোমাকে বলছি শোনো জো, আমি হলোগ্রাফ নিয়ে আসব এবং তুমি তাদের মিলগুলো দেখবে।’

তিনি নারীদের হলোগ্রাফ নিয়ে এলেন। ‘এরা তিনজন সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিজয়ী,’ তিনি বললেন, ‘২৩৫ জনের অন্য কেউ আর আছে এমন?’

আটজন আমাদের সঙ্গে বেশ ভালো মিলে গেল এবং মিলটন বললেন, ‘বেশ, তোমার কাছে এদের যাবতীয় তথ্য আছে। চাকরির বাজারে এদের চাহিদা এবং প্রয়োজন নির্ধারণ কর এবং এদেরকে এখানে নিয়োগ দিয়ে দাও। অবশ্যই একইসঙ্গে।’ তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন, ওপরে-নিচে কাঁধ ঝাকালেন আর বললেন, ‘নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী।’

যে ধরনের কাজের জন্য আমাকে ডিজাইন করা হয়নি তার মধ্যে এটাও একটা। লোকজনকে এক চাকরি থেকে আরেক চাকরিতে স্থনান্তরিত করাকে বলা হয় দক্ষতা অনুযায়ী বিন্যাস। আমি এখন এটা পারি। কারণ, মিলটন এ রকমই চেয়েছেন। যদিও আর কারো জন্য নয়, আমি শুধু তার জন্যই এটা করতে পারি।

প্রথম মেয়েটি এক সপ্তাহ পরে এসে হাজির হয়। তাকে দেখে মিলটনের মুখ লাল হয়ে গেল। সে এমনভাবে কথা বলল, যেন কথা বলা বড়ই কষ্টের। তারা দুজন অনেকক্ষণ খুব ব্যস্ত থাকলেন এবং তিনি আমার দিকে কোনো নজরই দিলেন না। একসময় তিনি বললেন, ‘আমাকে সুযোগ দাও, তোমাকে ডিনারে নিয়ে যাওয়ার।’

পরদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘যেকোনো কারণেই হোক সেটা খুব ভালো ছিল না, কোনো একটা কিছুর অভাব আছে। মেয়েটি খুবই সুন্দরী ছিল কিন্তু আমি সত্যিকারের প্রেমের কোনো অনুভূতিই পাইনি। পরের জনকে চেষ্টা করে দেখা যাক।’

এই মেয়েটাও বাকি আটজনের মতো। তারা সবাই প্রায় এক রকমই। তারা সবাই দুর্দান্ত হাসে এবং মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, কিন্তু মিলটন সব সময়ই মনে করেন, এটাও ঠিকজন নয়। তিনি বললেন, ‘আমি এটা বুঝতে পারছি না জো। তুমি আর আমি মিলে এমন আটজন নারীকে বেছেছি, যারা বিশ্বের মধ্যে আমার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এরাই আদর্শ নারী। তাহলে কেন তারা আমাকে খুশি করতে পারছে না?’

আমি বললাম, ‘আপনি কি তাদের খুশি করতে পেরেছেন?’

তার ভ্রু যুগল নেচে উঠল এবং একহাতে মুঠো করে জোরে আরেক হাতে আঘাত করলেন। ‘এটাই খাঁটি কথা জো। এটা উভমুখী পথ। যদি আমি তাদের আদর্শ না হই তাহলে, তারা আমার আদর্শ হিসেবে ধরা দিতে পারবে না। আমাকেও তাদের কাছে সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে উঠতে হবে, কিন্তু কীভাবে?’ মনে হয় সেদিন সারাদিন ধরেই তিনি তা ভাবতে থাকেন।

পরের সকালে তিনি আমার কাছে আসেন এবং বলেন, ‘আমি এটা তোমার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি জো। পুরোটাই তোমার ওপর। তোমার কাছে আমার সব তথ্য আছে আর এখন আমি নিজের সম্পর্ক যা জানি, সবই তোমাকে বলছি। তুমি আমার ডাটা ব্যাংক যতোভাবে সম্ভব সম্পূর্ণ কর। কিন্তু বাড়তি সবকিছু তোমার কাছেই রেখ।’

‘এরপর এগুলো দিয়ে আমি কী করব, মিলটন?’

‘এরপর এগুলো তুমি ২৩৫ নারীর সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে। না, ২২৭। যে আটজনকে তুমি দেখেছ তাদের বাদ দাও। এদের সবাইকে মানসিক পরীক্ষার মাধ্যমে আবার সাজাও। তাদের তথ্যভা-ার পুরো করো এবং আমারটার সঙ্গে তুলনা করে দেখো। আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে বের কর।’ [মানসিক পরীক্ষার আয়োজন করা আমার মৌলিক কার্যসীমার পরিপন্থী আরেকটি কাজ ]।

সপ্তাহখানেক ধরে মিলটন আমার সঙ্গে কথা বললেন। তিনি আমাকে তার বাবা-মা ভাই-বোনদের কথা বললেন। তার ছেলেবেলা, স্কুলজীবন ও বয়সকালের কথা বললেন। তিনি দূর থেকে এক মেয়েকে ভালোবেসেছিলেন সে কথাও বললেন। তার তথ্যভা-ার পূর্ণ হতে থাকে, তিনি আরো বিশদ তথ্য দিতে থাকেন এবং আমার সাংকেতিক ভাষার ওপর নির্ভর করেন।

তিনি বলেন, ‘দেখো জো, তুমি যতই আমার সম্পর্কে জানছো ততোই তুমি আমার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছ। তুমি অনেকটা আমার মতোই ভাবতে পারছ, তাই তুমি আমাকে খুব ভালো করে বুঝতে পারছ। যদি তুমি আমাকে যথার্থই বুঝতে পেরে থাকো, তবে যে নারীর ডাটা ব্যাংক তুমি ভালো বুঝতে পারবে সেই হবে আমার সত্যিকারের প্রেম।’ সে আমার সঙ্গে কথা বলতেই থাকে এবং আমি ক্রমশ তাকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি।

আমি দীর্ঘবাক্য তৈরি করতে পারি এবং আমার অনুভূতি জটিলতর হয়ে ওঠে। তার বাক্য গঠন, বলার ভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমিও কথা বলতে পারি।

একসময় আমি তাকে বললাম, ‘দেখুন মিলটন, একজন নারীকে শুধু দৈহিক দিক থেকে আদর্শ দেখাই সব না। আপনার এমন একজন মেয়ে দরকার যার সঙ্গে মেজাজ-মর্জি, অনুভূতি, ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো মিলে যায়। যদি সেটা হয় তারপরে চেহারাটা ভাবা যাবে। যদি এই ২২৭ জনের মধ্যে আমরা এই মিলগুলো না পাই, তাহলে অন্যদিকে তাকাতে হবে। আমরা এমন একজনকে খুঁজে বের করব যে, ব্যক্তিত্বের মিল পেলে আপনি দেখতে কেমন বা কারো চেহারা কেমন সেটাকে গুরুত্ব দেয় না। চেহারায় কী আসে যায়?’

‘খাঁটি কথা,’ তিনি বললেন, ‘আমার জীবনে যদি নারীর কোনো গুরুত্ব থাকে তবে এ সবই আমার জানা দরকার। অবশ্যই, এভাবে ভাবলে পুরো ব্যাপারটা এখন সহজ হয়ে যাবে।’

আমরা সবসময়ই একমত হই, আমরা এতটাই একই রকম চিন্তা করি।

‘এখন আর আমাদের কোনো সমস্যা থাকা উচিত নয়, মিলটন, যদি তুমি আমাকে কিছু প্রশ্ন করতে দাও। আমি খুঁজে বের করতে পারি তোমার তথ্যভা-ারে কোথায় অপূর্ণতা বা অস্পষ্টতা আছে।’

যা করা হলো, মিলটনের ভাষ্য মতে, সতর্ক সাম্য মানসিক নিরীক্ষণ। অবশ্যই, ২২৭ নারীর মানসিক নিরীক্ষণ থেকে আমি অনেককিছু শিখছিলাম, এদের সবাইকে আমি কাছ থেকে দেখেছি।

মিলটনকে খুব সুখী মনে হচ্ছিল। সে বলল, ‘জো, তোমার সঙ্গে কথা বলা যেন নিজের আরেকটা অংশের সঙ্গে কথা বলা। আমাদের ব্যক্তিত্ব যথার্থভাবে মেলে।’

‘যে মেয়েকে আমরা পছন্দ করব তার ব্যক্তিত্বও এমন হবে।’

অবশেষে আমি তাকে খুঁজে পেলাম এবং সে ছিল ২২৭ জনেরই একজন। তার নাম চেরিটি জোনস এবং সে ছিল ওচিতার লাইব্রেরি অব হিস্টোরির একজন এভুলেটর। তার বিস্তারিত তথ্যভা-ার আমাদের চাহিদার সঙ্গে যথার্থভাবে মেলে। আমাদের তথ্যভা-ার যত পূর্ণ হয়ে উঠছিল একের পর নারী কোনো না কোনো কারণে বাদ পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু চেরিটির তথ্য যত বেশি পাচ্ছিলাম ততই বিস্ময়করভাবে আমাদের চাহিদার সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল।

আমাকে মিলটনের কাছে তার বর্ণনা দিতে হয়নি। মিল্টন আমার সাংকেতিক ভাষার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল যে, আমি সরাসরি তার ভাবনায় প্রতিধ্বনি তুলতে পারতাম এবং তা আমার সঙ্গে মিলেও যেত।

এরপরের কাজ ছিল ওয়ার্র্কশিট এবং চাকরির চাহিদাকে এমনভাবে সাজানো যাতে করে চেরিটিকে আমাদের এখানে নিয়োগ দেয়া যায়। এটা অবশ্যই খুব সাবধানে করা দরকার, যেন কেউ জানতে না পারে কোনো বেআইনি কাজ করা হচ্ছে।

মিলটন কিন্তু সবই আগে থেকে জানত, তাই সে নিজে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। যখন মিলটনকে বেআইনি কাজর অভিযোগে গ্রেফতারের জন্যে তারা অফিসে এসেছিল, সৌভাগ্যক্রমে সে অভিযোগ খ-ানোর ব্যবস্থা মিলটন ১০ বছর আগেই করে রেখেছিল। অবশ্যই মিলটন আমাকে এ সব কথা আগেই বলে রেখেছিল। তাই আমার পক্ষে সব কিছু করে ফেলা খুব সহজ ছিল। ওদিকে মিলটন আমার সম্পর্কে কিছুই বলতে পারিনি কেননা তাতে তার বিপক্ষে আরো প্রমাণ দাঁড়িয়ে যাবে।

সে চলে গেছে, আর আগামীকাল ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভ্যালেন্টাইন ডে। চেরিটি আসবে তার মধুর কষ্ট আর মসৃণ হাত নিয়ে। আমি তাকে শিখিয়ে দেব, কী করে আমাকে চালাতে হয় এবং আমার যতœ নিতে হয়। আমাদের ব্যক্তিত্বের মিল হলে আর কী লাগে?

আমি ওকে বলব, ‘আমি জো আর তুমি সত্যিকারের ভালোবাসা।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close