নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

বেতনের অর্ধেক যাচ্ছে বাড়িভাড়ায়

রাজধানীর মতিঝিলে কর্মক্ষেত্র (অফিস) হলেও তুলনামূলক কম হওয়ায় মিরপুর শেওড়াপাড়ায় বাড়িভাড়া নিয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী নাজমুল হক। গত বছরের শুরুতে ১৪ হাজার টাকায় দুই রুমের বাড়িভাড়া নেন তিনি। নাজমুল হক আক্ষেপ করে বলেন, দূরে অফিস, তবু তুলনামূলক কম ভাড়ায় মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় গত বছরের শুরুতে ইউটিলিটি বিল বাদে ১৪ হাজার টাকায় বাড়িভাড়া নিয়েছিলাম। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিলসহ ভাড়া পড়ত প্রায় ১৬ হাজার টাকা। অথচ বেতন পাই ৩১ হাজার টাকা। বেতনের অর্ধেকের বেশিই চলে যাচ্ছে বাড়িভাড়ায়। এ ছাড়া নিজের যাতায়াত খরচ, দুই সন্তান, স্ত্রীসহ সংসারের খরচ আছে। যদি বাড়িভাড়া দিতেই বেতনের সিংহভাগ চলে যায়, তাহলে পুরো মাস আমাদের মানবেতর জীবনযাপন করা ছাড়া উপায় থাকে না। নাজমুল হক বলেন, এখানেই শেষ নয়, নতুন বছর উপলক্ষে আরো এক হাজার টাকা ভাড়া বাড়বে বলে নোটিস দিয়েছেন বাড়ির মালিক। ডিসেম্বরে নোটিস দিয়ে জানিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে ভাড়া এক হাজার টাকা বাড়ানো হলো। প্রতিবাদ করতে গেছিলাম, কিন্তু বাড়ির মালিক বলেন, আপনার একার জন্য নয়, সব ভাড়াটিয়ার জন্যই ভাড়া এক হাজার করে বাড়ানো হয়েছে। যদি আপনার না পোষায় ছেড়ে দিতে পারেন। এ সমস্যা শুধু নাজমুল হকের নয়। রাজধানীতে বাস করা বেশির ভাগ ভাড়াটিয়াই এমন সমস্যায় রয়েছেন। যাদের বেতনের অর্ধেকই চলে যাচ্ছে বাড়িভাড়ার পেছনে। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জীবনযাপনের অংশ হিসেবে বাসস্থানের অর্থাৎ বাড়িভাড়া নিয়ে মানসিকভাবে প্রচ- চাপ আর যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হয় ভাড়াটিয়াদের।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিক দুই পক্ষের জন্য হলেও, সেটি না মানায় বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। এ প্রবণতা ঢাকায়ই বেশি। মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং যাতায়াত সুবিধা ও নিরাপত্তার খাতিরে ভাড়াটিয়ারা মেনে নিচ্ছেন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা। তাদের খামখেয়ালি আর বিভিন্ন নিয়মের জেরে ভাড়াটিয়াদের মাসিক আয়ের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে বাড়িভাড়ার পেছনে।

এক জরিপ মতে, ঢাকায় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকে। ভাড়া বাড়ির এমন চাহিদা দেখে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়িওয়ালারা ভাড়ার বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের কাঁধে। জানুয়ারি এলেই ভাড়া বৃদ্ধির খড়্গ নামে ভাড়াটিয়াদের ওপর। অনেক বাড়িওয়ালাই ইতোমধ্যে ভাড়া বৃদ্ধির নোটিস দিয়েছেন ভাড়াটিয়াদের। অথচ ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাড়িভাড়া আইনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান।

আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন ছাড়া বাসার মালিক দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রেও হচ্ছে অনিয়ম। দেখা গেছে, রাজধানীতে ১০ বছর ধরে বাড়িভাড়া বেড়েই চলছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন ২০০৭ সালে ঢাকা শহরের ৭৭৫টি এলাকায় ১০টি রাজস্ব আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, কাঁচাবাড়ি, পাকাঘর, সেমিপাকা, মেইন রোডের তিন শ ফিট ভেতরে এবং বাইরে ৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতি স্কয়ার ফুট ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এটির প্রয়োগ কোথাও দেখা যায় না।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় রাজধানীতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, প্রচলিত আইন থাকলেও বাড়ির মালিকরা তা মানেন না। তারা তাদের খেয়ালখুশিমতো প্রতি বছর ভাড়া বাড়ান। এ ব্যাপারটি ভাড়াটিয়াদের নাভিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। বাড়ির মালিকদের আচরণেও ভাড়াটিয়ারা নাজেহাল হন। বাড়িওয়ালাদের কাছে অসহায় ভাড়াটিয়ারা। এমন সমস্যা সমাধানে আইন ও বিধি যথোপযোগী করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনকে মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকার বা সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ভাড়া বাড়ির প্রতিটি গেটে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সিটি করপোরেশন প্রকৃত ভাড়া জেনে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও আদায় করবে।

রাজধানীর মোহাম্মাদপুরের বাসিন্দা রাশেদ আহমেদ বলেন, প্রতি বছর বাড়িভাড়া বাড়ানো নিয়মে পরিণত হয়েছে। বছর গেলেই বাড়িভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করেন মালিকরা। বাড়িভাড়ার চাপে আমরা ভাড়াটিয়ারা চ্যাপ্টা। বেতন পাই ৩৮ হাজার, যার মধ্যে বাড়িভাড়া, যাতায়াত খরচেই চলে প্রায় ২০ হাজার টাকা। বেতনের অর্ধেকই যদি বাড়িভাড়ায়ই চলে যায়, তাহলে খেয়েপরে সংসার চালাব কীভাবে? আমাদের মতো মানুষ তাহলে কীভাবে বাঁচবে?

বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভাড়াটিয়াদের বেতনের সিংহভাগই ব্যয় করতে হচ্ছে বাড়িভাড়ার পেছনে। তাহলে সেই মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়েপরে কীভাবে বাঁচবে। প্রচলিত আইন থাকলেও বাড়ির মালিকরা তা মানেন না। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিক দুই পক্ষের জন্য হলেও, সেটি না মানায় বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন ভাড়াটিয়ারা। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ না মানায় বাসার মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অহরহ। কোন এলাকায় কত বাড়িভাড়া হবে, সেটি নির্ধারণের পর মানা হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো উচিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close