চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ২১ জুন, ২০২২

চট্টগ্রাম নগরী

টানা বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটুপানি

তিন দিনের লাগাতার বর্ষণ ও রবিবারের সারা রাতের টানা ভারী বৃষ্টিতে নজিরবিহীনভাবে ডুবেছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। নগরীতে এই অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ধসে আরো এক শিশুর মৃত্যুসহ এ নিয়ে নগরীতে গত কয়েক দিনে পাহাড়ধসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচজনে।

একে তো শুক্রবারের ভারী বর্ষণের পর থেমে থেমে বৃষ্টিতে নগরীতে অধিকাংশ এলাকার বাসাবাড়ী, স্কুল-কলেজ, অফিস আদালত এলাকা হাঁটু-কোমর পানিতে জলমগ্ন ছিল। তবে রবিবার সারা রাতের বৃষ্টি সাম্প্রতিককালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। অধিকাংশ এলাকার নিচতলায় নালা-নর্দমার নোংরা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এছাড়া নতুন নতুন এলাকায় পানি প্রবেশ করে এক নজিরবিহীন অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন এসব এলাকায় বসবাসকারী লক্ষাধিক মানুষ।

নগরীর আমবাগান আবহাওয়া অফিস সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের কথা জানায় যা সাম্প্রতিককালের রেকর্ড বলে প্রতিদিনের সংবাদকে জানান আমবাগান আবহাওয়া টিপিও আবদুল হান্নান দেওয়ান। অপরদিকে নগরীর পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসও পতেঙ্গা একই সময়ে ২৪২ দশমিক ২ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে জানায়। বহদ্দারহাট থেকে নগরমুখী বিভিন্ন সড়কগুলোর ওপর উঠে গেছে কোমরপানি। পার্কিং, দোকানপাটে পানি ঢুকেছে। দুর্ভোগের শেষ নেই অফিসফেরত ঘরমুখো মানুষ, পথচারীদের।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সোমবার সকাল ৯টায়ও বহদ্দারহাট প্রধান সড়ক সংলগ্ন বহদ্দারবাড়ীতে নগরপিতার বাসভবনের নিচতলায় কোমর সমান পানি। রবিবার রাতে ভারী বর্ষণে নগরীর কাপাসগোলা, বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার, ষোলশহর দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, আগ্রাবাদ, কাতালগঞ্জ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, চকবাজার, প্রবর্তক মোড়সহ নগরীর অধিকাংশ এলাকা সড়কে ছিল কোথাও কোমরপানি কোথাও গলা সমান পানি। সড়কের মাঝখানে ইঞ্জিন বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক গাড়ি। পানি থেকে বাঁচতে নিরাপদ পথ খুঁজতে গিয়ে নগরীর বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ও আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে উঠে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। বেসরকারি সুপরিচিত সেবা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের পুরাতন ভবনের নিচতলা ও আশপাশের নিচতলায় আছে শিশু ওয়ার্ড, অভ্যর্থনা কক্ষ, বহির্বিভাগ ও প্রশাসনিক বিভাগ। এসব সেবা অন্য জায়গায় সরিয়ে নিলেও আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়েছেন পুরাতন হাসপাতাল দিয়ে চলাচল করা রোগী ও স্বজনরা।

এদিকে টানা বৃষ্টিপাতের মধ্যে রবিবার (১৯ জুন) রাতে নগরীর পাঁচলাইশ থানার গ্রিনভ্যালি আবাসিক এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনায় মো. রায়হান (১২) স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র মারা যায়। সে স্থানীয় ভাসমান চা দোকানি দীন মোহাম্মদের ছেলে। তাদের বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলায় বলে পুলিশ জানিয়েছে। পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন মজুমদার জানান, গ্রিনভ্যালি আবাসিক মসজিদের পেছনে পাহাড়ের পাদদেশে দীন মোহাম্মদের একটি ভাসমান চা দোকান আছে। রাতে ওই দোকানে ঘুমিয়েছিল রায়হান। বৃষ্টির মধ্যে রাতের কোনো একসময় পাহাড়ধসে পড়ে দোকানের ওপর। ঘুমন্ত অবস্থায় মাটির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারায় রায়হান। ভোরে দীন মোহাম্মদ দোকান খুলতে গিয়ে এ ঘটনা দেখেন।

স্থানীয়রা মিলে মাটি সরিয়ে রায়হানের লাশ উদ্ধার করেন। পাহাড়ে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের গত কয়েক দিনের উচ্ছেদ অভিযানে পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা এ পর্যন্ত ১৮০টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। গত রবিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল পর্যন্ত পূর্ব ফিরোজশাহের ১ নম্বর ঝিল এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা হয়।

এদিকে নগরীর পানি নিমজ্জিত এলাকার ভুক্তভোগীরা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের নেওয়া হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কাজ চললেও সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যেকার সমন্বয়হীনতার কারণে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে এখনো মুক্ত হতে পারছে না নগরবাসী।

খালের মুখে বাঁধ, নালা ও খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ না করার অভিযোগও করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব এলাকাবাসী। পুরো বর্ষা মৌসুম আসার শুরুতেই এ জলাবদ্ধতায় কেউ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী হতে সবশ্রেণির মানুষের দুর্ভোগ দুর্দশার সীমা নেই।

সূত্রে জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরীতে চলমান ৯ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩টি প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। একই বছরের ২৫ এপ্রিল অনুমোদনের পর ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএ ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক কাম বাঁধ নির্মাণ’ প্রকল্পের চলছে। এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৯ সালে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড হাতে নেওয়া আরেকটি প্রকল্পে ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপনের পাশাপাশি কর্ণফুলীর তীরে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধক দেয়াল নির্মাণকাজও চলমান আছে বলে জানা যায়।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের উদ্যোগে উদীয়মান ও পুনরুত্থিত রোগ এবং জাতীয় জরুরি অবস্থা মোকাবিলা বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের করণীয় বিষয়ক এক অ্যাডভোকেসি সভা ১৯ জুন রবিবার বিকালে সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়ার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় সভায় জরুরি অবস্থার প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক কারণ প্রাণ ও স্বাস্থ্যের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্যকর্মীদের এগিয়ে আসার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় বৈঠকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close