মাহমুদ নাঈম

  ০৮ জানুয়ারি, ২০২২

করিম ও দাদুর গল্প

উফ! ডাহেন ক্যান? ম্যালা রাইত অইছে... কী ঠাণ্ডাইনি ফরছে। হগলে মাত্র বস্তাই হুইয়া সইলাডারে গরম করছি।

আর পারুম না। আফনেগোর মালফত্র আফনেরা লইয়া যাইন।

অই চেমরা আমি তোর দাদু কি আবোল-তাবোল কইতাছচ। উইটে দুগা খাইয়েলো হারাডাদিন তো রেললাইনে মাইনচের ফরমাইস কইরা বেরাস। কিছুই তো মুখে লইয়া দেহস না। উঠ! খাইয়া তারফর আমার লগে ঘুমা।

করিম পথশিশু। আর দাদুর যেন কেউ থেকেও নেই।

অন্যের বাসায় কাজ করে করিমকে বড় করেছে। করিম সেও জানে। সে তার আসল দাদু নয়। ছোটবেলায় পথের দ্বারে ওয়াও ওয়াও চিৎকার করতেছিল তখন দাদু পেয়ে নিয়ে এইটুকু বড় করেছে। বয়স সবে মাত্র হবে ৯/১০-এর আশপাশে। দাদুর অবস্থা এখন যায় যায়। তাই দাদুর বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল করিম।

দাদু করিমকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছে। রোজ প্রতিদিন রেললাইনে কুলির কাজ করে দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে আছে জীবন।

করিম! ও করিম ম্যালা বেলা অইছে যাইবে না। রেললাইনে আজকা না গেলে খাইবে কী?

মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়েই দেখে করিমের জ্বর।

আহা! হারাডাদিন না খাইয়া, আর অত রাইত কইরে ঠাণ্ডা ডা লাগাইয়া আইছচ। এল্লাইগা জ্বর উঠছে।

আজকা তোর যাওন লাগবো না। আমি দেহি গা কারো কাছ থাইক্যা কিছু আনতে ফারি কী না।

এই তোরে জল ফট্টিডা দে গেলাম। দুগা মুড়ি আছে খাইয়া লইস।

অত্ত রাও কইরো না দাদুজান। তুমার কোন হানো যাওয়ান লাগবো না।

আমি ইট্টু ফরে যামুনে, আজকা চেয়ারম্যান গো বাইত ম্যালা খাওন। অই হানে জাইয়া কিছু লইয়া আমু নে। কওছেন দাদু তুমি ছাড়া আর কেডা আছে আমার!

দাদু ভোঁ ভোঁ করে কেঁদে কেঁদে বলে। হায়রে আমার কফাল পড়ালেহা করাইলাম এহন বউ-বাচ্চা লইয়া আরামে তাহে ইয়া বড় বড় দালানে। আমারে কোনো দিন আইয়্যা দেহেও না একনজর। ও দাদু! দাদু কান্দ কেরে। ক্ষুধা লাগছে! খারাও ইট্টু ফরে যাইতাছি আজগা চেয়ারম্যান গো বাইত ভালা খাওন আছে। ভোডাবেডির খাওন। দুপুর গড়াতে চেয়ারম্যান বাড়িতে করিম হাজির।

রীতিমতো যা হয় আর কী আমাদের দেশে। পথশিশু ও অসহায়দের অবহেলা আর বঞ্চনা স্বীকার আজও তার ব্যতিক্রম নই।

করিমকে খেতে দিচ্ছে না পথশিশু বলে। শাহিদার বলে দিয়েছে সবার খাওয়া শেষ হলে খাতে হবে।

করিম ড্যাপড্যাপ কইরা চাইয়্যা দেখতেছে, সবাই গদগদ কইরে খাইতেছে। হাত দিয়ে জুল গড়াইতাছে, জিব্বা দে চাইট্যা খাইতাছে। তাতেও কোনো আফসোস নেই। তবে উল্টো দিখে চোখ ফিরাতেই দেখে করিমের মতো একটি ছেলেকে বাবা মুখে তুলে খায়িয়ে দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে করিমের চোখে জল চলে এলো। শাহিদার সকলের খাওয়া দাওয়া শেষে করিমকে ডেকে নিয়ে এক পুঁটলা খাওন দিয়ে দিল।

যাগ গে করিম শেষবেলা খাওন পাইয়্যা খুব খুশি। দৌড়ে বস্তিতে এসে দাদুকে নিয়ে খেয়ে নিল।

এভাবেই চলে করিম ও দাদুর জীবনযাপন। কেউ দেখেও দেখছে না।

কেউ থেকেও কেউ নেই।

শুধু অবহেলা আর অবহেলা।

বস্তিবাসীর কাছে শীত মানে দুর্দশার এক ঋতু। কনকনে শীত। হিমপ্রবাহ, অতিবাহিত করতে হয়। কখনো দিনের বেলা সূর্যের দেখাও মিলে না।

করিমের প্রতিদিনের মতোই রাত গড়িয়ে ভোর হয়। কাজে ফিরে। এভাবেই গত হয় দিনের পর দিন। তবে আজকের ভোর করিমের কাছে বিভীষিকার মতো। কুয়াশার ঘন আচ্ছাদন। কেউ কোথাও নেই। চোখ যতদূর যায় শুভ্রতা। করিম দাদুকে ডাকছে ও দাদু! দাদুজান কথা কও না ক্যান? দাদু! ও দাদু। কোনো উত্তর নেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close