সাইফুল্লাহ মনসুর ইসহাক

  ০৬ জানুয়ারি, ২০১৮

রাজবাড়ীর রহস্য

আজই বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো। তাই রিফাত খুব খুশি। কারণ এক মাসের লম্বা ছুটিতে আনলিমিটেড ঘোরাঘুরি হবে। হোমওয়ার্কের টেশন নেই, স্যারের বকা খাওয়ারও কোনো চান্স নেই। কিন্তু রিফাত শহরের এই কর্মব্যস্ত চিরচেনা পরিবেশে আর থাকতে চায় না। প্রাণভরে যেখানে নির্মল বাতাস নেওয়া যায়, যেখানে সবুজের ছড়াছড়ি, পাখপাখালির কিচিরমিচির, বহমান নদী, মাঠভরা ধান থাকবে, থাকবে সারি সারি পাল তোলা নাও, এমন কোথাও সে হারিয়ে যেতে চায়। ঢাকা শহরে শুধু বড় বড় দালান। এসবের দেখা খুব কমই মিলে। রিফাত তার আঁকার খাতায় ছবি আঁকত আর কল্পনায় হারিয়ে যেত। এবার তাকে আর কল্পনায় ভেসে বেড়াতে হবে না। কারণ পরীক্ষার আগেই রিফাতের মা কথা দিয়েছেন পরীক্ষার পর লম্বা ছুটি বড় ফুফুর বাড়িতে কাটাবেন।

আগামীকালই তারা সিলেট যাচ্ছে শুনে রিফাতের খুশি আর ধরে না। রিফাতের বড় ফুফুর বাড়ি শ্রীমঙ্গলে। সুতরাং চায়ের রাজ্য ডুব দেওয়া যাবে নিঃসন্দেহে।

প্রথম যাত্রা ট্রেনে তাই আনন্দটাও সেই রকম। ফুফা সিলেট থেকে রিসিভ করবেন তাদের। রিফাতের ফুফা চা বাগানে চাকরি করেন। স্থানীয় চা বাগানের বিশাল এলাকা তাকে দেখাশোনা করতে হয়। বাগানের মালিক মাসে একবার আসেন চা বাগান দেখতে। রিফাত ট্রেনের জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। Ñ‘ওখানে গিয়ে কোনো ধরনের দুষ্টুমি করবি না।’ মায়ের এমন আদেশে সে জানালার বাইরে থেকে চোখ সরাল।

Ñ‘ঠিক আছে মা।’ সে আবার জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। বাইরের গাছগুলো মনে হচ্ছে পেছন দিকে ছুটে চলে যাচ্ছে। যথাসময়ে ট্রেন সিলেট স্টেশনে পৌঁছল। সবাই নামল। বড় ফুফা স্টেশনে অপেক্ষা করছেন। সঙ্গে রিফাতের বয়সী তার ফুফাতো ভাই। Ñ‘আসসালামুআলাইকুম’। রিফাত ফুফাকে সালাম করে। ফুফা সালামের জবাব দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। Ñ‘কেমন আছেন দুলাভাই?’ রফাতের বাবা বললেন। Ñ‘এই তো আছি। এত দিন পর আমাদের কথা মনে হলো?’ Ñ‘আসলে কাজের ব্যস্ততার জন্য আসা হয় না।’ ‘আচ্ছা চলো বাড়ি গিয়ে কথা হবে। এখনো অনেক রাস্তা বাকি।’ রিফাতের ফুফা সবাইকে গাড়িতে নিয়ে গেলেন। এরই মধ্যে রিফাত তার ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে বেশ গল্পের ভাব জমিয়ে ফেলেছে।

শেষ বিকেলে তারা বাড়ি পৌঁছে গেল। রাতের খাওয়া-দাওয়া চলছে।Ñ‘রিফাত পরীক্ষা কবে শেষ হলো?’ রিফাতের ফুফু বললেন। Ñ‘এই তো ফুফু গতকালই শেষ হলো।’ Ñ‘এবার কিন্তু তোদের ছাড়ছি না। অনেক দিন থাকতে হবে।’

Ñ‘হ্যাঁ এবার বেশ কয়েক দিন থাকব। তাই তো এত বড় লাগেজ আনতে হলো।’ রিফাতের মায়ের কথায় সবাই গেসে উঠল। রাতে রিফাত আর রিফাতের ফুফাতো ভাই রাহাত একসঙ্গে ঘুমাবে। ফুফু বিছানা ঠিক করে দিয়েছেন।

Ñ‘আচ্ছা রাহাত তোমাদের এখানে অনেক চা বাগান না?’Ñ‘হ্যাঁ’, Ñ‘কাল সকালেই আমরা চা বাগান দেখতে যাবো’।Ñ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ রাহাত একেবারে শান্ত প্রকৃতির, কথা ও কম বলে।

পরদিন সকালে তারা চা বাগান দেখতে বের হলো। সারিসারি চা বাগান। আর নানা ধরনের পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারদিক। আবার চা বাগানের নিচ দিয়ে ছোট একটি নদীও বয়ে চলেছে। রিফাত আর রাহাত আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ছুটে চলেছে।

Ñ‘এখানে একটি পুরোনো রাজবাড়ী আছে। ভয়ংকর একটা জায়গা। এখানে দিনের বেলাও কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।’

Ñ‘বলো কী! তুমি কখনো শুনতে পেয়েছো?’ Ñ‘না তবে বাগানের অনেক কাজের লোক নাকি কান্নার আওয়াজ শুনেছে।’ Ñ‘কিন্তু এমনটা কেন হয়?’ Ñ‘শুনেছি এখানে একসময় প্রতাপশালী এক রাজা ছিলেন। এই বিশাল এলাকাজুড়ে তার রাজত্ব ছিল। আর সেই রাজা খুব অত্যাচারী আর অহংকারী ছিলেন। এক দিন এক লোক রাজার বাগান থেকে ফল খাওয়ায় রাজার আদেশে তাকে চাবুক দিয়ে রক্তাক্ত করে হত্যা করা হয়। সেই রাজা পাগলের মতো আচরণ করতে থাকেন। একসময় তিনি কোথায় হারিয়ে যান কেউ তার খোঁজ বের করতে পারেনি। এরপর থেকেই এখানে কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। কেউ কেউ বলেন, সেই সেই মৃত ব্যক্তির আত্মা নাকি এখানে কান্না করে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে সাদা কাপড় পরা একজন লোক দেখা যায়। তাই দিনের বেলাও এখানে কেউ যায় না।’

Ñ‘চলো তো ওখান থেকে একটু ঘুরে আসি।’

Ñ‘তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? না বাবা আমি ওখানে যেতে পারব না।’

কিন্তু রিফাত নাছোড়বান্দা, সে ওখানে যাবেই। অবশেষে রিফাতের জোরাজুরিতে রাহাত রাজি হলো। তারা দুজনেই হাঁটছে ধীরগতিতে। রাহাতের মুখ শুকিয়ে গেছে ভয়ে। কিন্তু রিফাত বেশ কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে এগোচ্ছে। বাড়িটা বেশ পুরোনো। চারদিকে জঙ্গলে আবৃত। প্রধান ফটকের পরেই একটা বিশাল বটগাছ। রাজবাড়ীটা দ্বিতল। সামনে একটা বিরাট আকারের ঘোরার মূর্তি। তার পরেই ওপরে ওঠার সিঁড়ি। রিফাত ওপরে যাওয়ার জন্য রাহাতকে ইশারা করল। সিঁড়িতে পা রাখতেই কারো হাঁটার শব্দ শোনা গেল। দুজনেই থেমে গেল। একটু পরেই কান্নার শব্দ শোনা গেল। তারা আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। এক দৌড়ে সোজা বাড়ি পৌঁছাল।

রাতে ঘুমানোর সময় রিফাত বলল,Ñ‘আমার মনে হয় এখানে অন্য কোনো রহস্য আছে, যা আমরা ধরতে পাড়ছি না।

Ñ‘কী হতে পারে তা?’

দুজনেই ভাবল। রিফাত এবার একটা প্ল্যান করেছে। রাহাতকে তা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিল। আর পরদিন রাজবাড়ী আবার যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন প্ল্যানমতো তারা রাজবাড়ীর পেছন দিকে ডুকল। পেছনের দেয়ালের ইটগুলো খসে পড়েছে, তাই ভেতরে ঢুকতে তেমন কোনো অসুবিধে হলো না। তারা খুব সাবধানে আর ধীরপায়ে সামনে এগোচ্ছে। শুকনো ঝড়া পাতাগুলো পায়ের নিচে পড়ে মড়মড় শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ গতদিনের মতো সেই আওয়াজ আবার শোনা গেল। আওয়াজটা ধীরে ধীরে কাছে আসছে। ভয়ে রাহাতের জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা। রিফাতও ভয় পাচ্ছে। খুব সাবধানে তারা দেয়ালের আড়ালে দাঁড়ালো। যত সময় যাচ্ছে আওয়াজটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে। একসময় তা দেয়ালের ওপাশে থেমে গেল, ঠিক যেখানে রিফাত আর রাহাত দাঁড়িয়ে। হাঁটার শব্দটা কিছুক্ষণের জন্য স্থির হলো তার পর আবার একই পথে ফিরে গেল। রিফাত ইশারা করল বাইরে যেতে। দুজনেই সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। ডানদিকের প্রথম ঘরটাতে ডুকতেই তারা বেশ কিছু স্টিলের ট্রাংক আর বস্তা দেখতে পেল। কিন্তু সেগুলো তালাবন্ধ থাকায় তারা কিছুই দেখতে পেল না।

আবার সেই পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। এবার বেশ দ্রুত আওয়াজ কাছে আসছে। রিফাতের ইশারায় দুজনেই দ্রুত কয়েকটা বস্তার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আর সে সময়ই দুটো লোক পিস্তলসহ ঘরে ডুকে চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে একজন আরেক জনকে বলতে লাগল : Ñ‘আমার মনে হয় পুলিশ আমাদের আস্তানার কথা জেনে ফেলেছে। তাই ডাকাতি করা স্বর্ণগুলো আজই সরিয়ে ফেলতে হবে। টাকা আর কাপড়ের বস্তাগুলো কাল ছোট টিলার গোডাউনে রেখে আসবি।’

Ñ‘জি বস।’

লোক দুটো বেরিয়ে গেল। রাহাত আর রিফাত আড়াল থেকে সব শুনছিল। তাদের আর বুঝতে বাকি থাকল না যে লোকগুলো আসলে ডাকাত। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার তারা সতর্ক দৃষ্টিতে পাশের ঘরে ডুকল। এ ঘরেও কয়েকটি বস্তা আর দেয়ালে একটি লম্বা সাদা কাপড় ঝোলানো। ঘরটি তারা ভালো করে দেখতে লাগল।

রাহাত বলল :Ñ‘তাহলে এটাই সে সাদা পোশাক!’

Ñ‘হুম, আমাদের আরো একটি জিনিস খুজে বের করতে হবে।’

Ñ‘কী সেটা?’

রিফাত পাওয়া গেছে বলে একটি ছোট কালো রঙের বাক্স হাতে নিল। কিন্তু ভুলক্রমে বাক্সের নিচে সুইচে চাপ পড়ায় তা থেকে কান্নার আওয়াজ হতে থাকল। রাহাত বলল :Ñ‘তাহলে এই অডিও রেকর্ডারই সেই কান্নার উৎস!’

ঠিক সেই মুহূর্তে লোকদুটোর পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। এবার তারা দৌড়ে আসছে। রিফাত আর রাহাত একসঙ্গে পালাও বলে দৌড় দিল। ঘরের ভাঙা দরজা পেরিয়ে রাজবাড়ীর পেছনদিকে বেরিয়ে এক দৌড়ে সোজা বাড়ি পৌঁছল এবং রিফাত তার ফুফাকে সবকিছু খুলে বলল।

ফুফা পুলিশকে ফোন করলেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থকে অনেক চুরি করা স্বর্ণ আর টাকাসহ দুজনকে আটক করল। আর রিফাত ও রাহাতকে তাদের সাহসিকতার জন্য ধন্যবাদ জানাল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist