জয়িতা শিল্পী

  ১৫ মার্চ, ২০২২

‘নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ রোল মডেল’

একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করলে জনগণের হয়ে কাজ করা সম্ভব। মানুষকে ন্যায়বিচার দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ আইন সম্পর্কে অজ্ঞ। তাই আইন মান্যতার প্রবণতা একেবারেই কম। আইনের প্রয়োগ বা কাউকে আইন মানতে বাধ্য করা জনপ্রিয় কাজ নয়, তাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজটি করতে হয়। বিভিন্ন কৌশল বা পন্থায় মানুষকে আইনের আওতায় আনতে হয়। আইনের শক্তি এ ক্ষেত্রে বড় শক্তি। ভয় দেখিয়ে কাউকে আইন মানতে বাধ্য করা যায় না। বরং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার মানসিকতা তৈরি করা প্রয়োজন। তাহলেই অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পাবে তথা অপরাধ দমনও সহজ হবে।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ যখন রোল মডেল, তখন এ কথা অনস্বীকার্য নারীরা অনেকখানি এগিয়েছেন। এই অগ্রযাত্রায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপই মূল। সেবামূলক পেশার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীদের প্রবেশের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশ

বাহিনীতে নারীরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে পুলিশ সুপার হিসেবে নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন দক্ষতার সঙ্গে। উপযুক্ত কর্মপরিবেশ পেলে নারীরা তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে এগিয়ে যেতে পারেন- এটিই তার প্রমাণ। শুধু পুলিশ সার্ভিস নয়, অন্যান্য চ্যালেঞ্জিং পেশায়ও নারীরা এগিয়ে আসছেন এবং তারা কৃতিত্বের পরিচয় দিচ্ছেন।

ছোটবেলা থেকে পুলিশ হব- এ রকম স্বপ্ন দেখেছি তা নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নগুলো পাল্টে যায়। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হয়েছি বলে ছোট থেকেই গানবাজনা, সাহিত্যচর্চায় আগ্রহ ছিল। স্কুলজীবনে সংগীতশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কলেজে এসে লেখালেখি শুরু। তখন থেকে কবিতা লিখি, প্রবন্ধ লিখি, কলেজের অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম আর ভাবতাম কণ্ঠশিল্পী হব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে স্বপ্নগুলো পাল্টে যেতে থাকে। তখন সমাজকর্মী হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। অ্যাকাডেমিক শিক্ষা শেষের আগেই টিউশনি করানো, পার্টটাইম চাকরি করেছি। এনজিওতে কাজ করেছি। কলেজে পড়িয়েছি। সরকারি একটা চাকরিতেও যোগদান করি। এরপর হঠাৎ মনে হলো, পাবলিক সার্ভিসে নাম লেখাতে হবে। অমনি সবকিছু ছেড়েছুড়ে বিসিএস পাস করার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। তত দিনে সমাজের বাস্তবতা, নারীদের অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে স্পষ্ট উপলব্ধি হয়েছে।

পরিবারে তিন বোনের মধ্যে সবার বড়। তবে একটি ভাই ছিল না বলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হতো। মনে হতো আমাকেই এটা নিশ্চিত করতে হবে। নিজের নিরাপত্তা এবং পরিবারের নিরাপত্তা সবই শুরু হলো নতুন স্বপ্ন দেখা পুলিশ অফিসার হব। এএসপি হিসেবে ২৭তম বিসিএসে ২০০৮ সালের ১৩ নভেম্বর যোগদান করি। সারদায় এক বছরের কঠিন প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে হয়। আমরা কঠোর শাসন, নিয়মানুবর্তিতা আর অনুশীলনের মাধ্যমে সিভিলিয়ান থেকে পুলিশ হয়ে উঠি। আজও মনে পড়ে সারদায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রবেশের পথে লেখা Sardah Makes a Man Police বরিশাল জেলায় ৬ মাসের শিক্ষানবিশ কাল শেষ করে যোগদান করি মাগুরা জেলায়। এএসপি সার্কেল ও এএসপি সদর পদে দুই বছর কাজ করি। ওই সময় থেকে গভীরভাবে উপলব্ধি হয় সমাজের নিরীহ মানুষের দুঃখণ্ডদুর্দশার কথা, নারীদের বঞ্চনা, পারিবারিক কলহ, বৈষম্য, নিপীড়ন ইত্যাদি সম্পর্কে। দরিদ্র-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়। আইনি পরামর্শ ও আইনি সহায়তা দিয়ে এবং ধৈর্য নিয়ে মানুষের কথা শুনলেই অনেক সময় সমস্যা-সমাধান হয়ে যায়। ভালোবাসা ও আন্তরিকতা দিয়ে অনেক কঠিন কাজও খুব সহজভাবে করা যায়। শুরু হয় পুলিশ জীবনের নতুন যাত্রা। কাজের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাই। নতুন কর্মোদ্দীপনায় দৌড়ঝাঁপ করে, মানুষের উপকারের পেছনে ছুঁটে কী যে অপার আনন্দের অনুভূতি, তা বলে বোঝানো যায় না।

এ যাবত সে চেষ্টাই অব্যাহত আছে। মাগুরা থেকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো গমন কর্মজীবনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ফিরে এসে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে রমনা বিভাগেও ডিএমপি হেড কোয়ার্টারে তিনটি বছর বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা। এরপর ময়মনসিংহ জেলা পুলিশে একটানা চার বছরের অধিক সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কাজের সুযোগ পাওয়া নিঃসন্দেহে যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার পরিচয় বহন করে। একই সঙ্গে মাঠপর্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতা জীবনের একটি বড় অর্জন। বর্তমানে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে কাজ করার সুযোগ কর্মজীবনে নতুন এক ব্যাপ্তি এনেছে। আট ইউনিটের সমন¦য়ে গঠিত এই এলিট ফোর্সে কাজ করার সুযোগ নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানি।

এরই মাঝে সংসার এবং সন্তান। সবকিছুর সমন্বয়ে চলছে জীবন। চলছে লেখালেখি। পুলিশে যোগদানের আগে বেশ কিছুদিন বাংলাদেশ বেতারে কাজ করেছি। সেটি ছিল আমার আরেকটি ভালো লাগার জগৎ। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে খুব আনন্দ পাই। বেতারে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, কবিতা পাঠ, আবৃত্তি করেছি। আবৃত্তিশিল্পীও ছিলাম। পুলিশিং পেশায় জড়িত হওয়ার পর থেকে নিজের সাংস্কৃতিক জগৎটাকে প্রায় হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম। গান আবৃত্তির পরিবর্তে লেখিলেখিতে জোর দিতে শুরু করি।

২০১৩ সালে প্রথম প্রকাশনা ছিল কাব্যগ্রন্থ ‘জলে দাগ কেটে দিও’। তারপর দ্বিতীয় প্রকাশনা ২০১৭ সালে প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রাজারবাগে প্রজার পুলিশ’। সেই থেকে প্রকাশনা অব্যাহত আছে। সর্বশেষ ২০২১ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অষ্টম প্রকাশনা হলো কাব্যগ্রন্থ ‘করোনাময় সূর্যোদয়’। আমার লেখার বেশির ভাগ অংশজুড়ে থাকে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু। এ ছাড়া নারী জাগরণ এবং সমসাময়িক বিষয়াবলি। লেখক হিসেবে পরিচিতি দারুণভাবে উপভোগ করি। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২২-এ আমার নবম প্রকাশনা দীর্ঘদিনের শ্রমসাধ্য ও কাঙ্ক্ষিত প্রয়াস ময়মনসিংহের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক গ্রন্থ ‘১৯৭১ : সম্ভ্রমের স্বাধীনতা’ হাতে পাওয়ার অপেক্ষায়।

পুলিশ জনগণের বন্ধু কি না? এটি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। পুলিশের কাজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও কর্মজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা। এই কাজ করতে গিয়ে পুলিশকে বিদ্যমান আইন প্রয়োগ করতে হয়। এই আইন প্রয়োগের কাজটি কখনো জনপ্রিয় হয় না। কারণ মানুষ স্বভাবত আইন মানতে চায় না। বরং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার জন্য আইন মানতে বাধ্য করা হয় এবং এই কাজের মূল দায়িত্ব পুলিশের ওপর বর্তায়। তবে পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করলে জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব। সে লক্ষ্যেই কাজ করছি।

নারীরা সমাজের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী। উপযুক্ত শিক্ষা, বাস্তবতার জ্ঞান না থাকায় তার নিজেদের অবস্থান, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ভালো-মন্দ জানেন না এবং বুঝতেও পারেন না। নারীদের গৃহবন্দি মনোভাব ও আচরণ শুধু নারীর নারীত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করে। নারী যে একজন মানুষ, এই উপলব্ধি জাগানো প্রয়োজন। স্বপ্ন দেখাতে হবে ডানা মেলে উড়বার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ সেই স্বপ্ন দেখার পথটি মসৃণ করে দিতে যিনি অগ্রপথিক। জয় হোক সব নারীর।

লেখক : পুলিশ সুপার ও উপপরিচালক, র‌্যাব-৪

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close