নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩

ক্রেতাদের ভোগান্তি

চিনিতে অস্থিরতা চার কারণে

দুই মাস না পেরোতেই আরেক দফা চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে, যা কার্যকর হবে ফেব্রুয়ারি থেকে। কিন্তু চিনির দাম বাড়িয়ে যে দর নির্ধারণ করা হয়েছে, তার চেয়ে ৮ থেকে ১৩ টাকা বেশিতে বেচাকেনা হচ্ছে বাজারে। চিনি নিয়ে অস্থিরতা নতুন নয়। দীর্ঘদিন থেকেই সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দরে চিনি বিক্রি হয়ে আসছে বাজারে। ক্রেতাণ্ডবিক্রেতারা বলছেন, সরকার কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে না বলে খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

উদ্যোক্তা ও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার কারণে চিনির বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। এক. ঋণপত্র খুলতে না পারায় চিনি আমদানি হচ্ছে কম। আবার ঋণপত্রের জটিলতায় বন্দরে আসা চিনির চালান খালাসে বিলম্ব হচ্ছে। তাতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেছে। দুই. বিশ্ববাজারেও চিনির দাম বাড়তি। তিন. ডলারের বিনিময়হার বাড়ায় গাণিতিক হারে শুল্ককরও বেড়েছে। চার. গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও নতুন করে দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে।

প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজির দাম ৪ টাকা বাড়িয়ে ১১২ টাকা এবং খোলা চিনি প্রতি কেজির দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাজারে প্রতি কেজি চিনি ১১৫ থেকে ১২০ টাকার কমে মিলছে না। তেজগাঁও সকালের বাজার এলাকার দোকানি রতন বলেন, ‘চিনিই বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছি। যেখানে দাম বাড়িয়ে ১১২ টাকা করা হয়েছে, সেখানে এখনই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। কেউ কেউ ১২৫ টাকাতেও বিক্রি করছেন। আবার চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। কাস্টমারের সঙ্গে তর্ক করতে পারব না। তাই বেচি না।’ কারওয়ান বাজারের কাঞ্চনপুর হাজী স্টোরের মিজানুর রহমান বলেন, ‘দাম বাড়ার আগে থেকেই এর চেয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। নতুন রেটে চিনি আসবে বলছে। আগের রেটেই তো বাড়তি দামে বিক্রি করছে সবাই। নতুন দরে এলে কী হবে জানি না।’

তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া এলাকার ক্রেতা জামিউল রেজা আপন বলেন, ‘কয়েক মাস থেকেই তো দেখছি, চিনির দাম যেটা নির্ধারণ করা হয়, তার চেয়ে বেশি দামেই বিক্রি হয়। এখন দাম বাড়িয়ে প্যাকেটজাত চিনি ১১২ টাকা করা হবে শুনলাম। কিন্তু কিসের প্যাকেটজাত, বাজারে চিনি ১১৫-১২০ টাকার নিচে নেই। এত দিন ধরে পত্রপত্রিকায় আপনারা লিখতেছেন, কিন্তু এটা নিয়ে তো কোনো সমাধান হইতেছে না। সরকার যতক্ষণ না কঠোর হবে, ততক্ষণ এর সমাধান হবে না।’

সংকট কাটছেই না : চিনির বাজারে আছে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। যেমন সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে কারখানায় পরিশোধনের পর বাজারজাত করে। সরাসরি পরিশোধিত চিনি আমদানি করে খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বছরে কমবেশি ২১ লাখ টন চিনি আমদানি হয়। দেশে উৎপাদিত হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টন। অর্থাৎ চিনির বাজার পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভরশীল।

এখন প্রতি মাসে গড়ে পৌনে দুই লাখ টনের কমবেশি চিনির চাহিদা রয়েছে। তবে চলতি অর্থবছর থেকে ঋণপত্র-সংকটে চিনি আমদানি কমে গেছে। যেমন গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই থেকে ২৫ জানুয়ারি) চিনি আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ৬৩ হাজার টন। এবার একই সময়ে আমদানি ৮ লাখ ৭৩ হাজার টন। আমদানি করা চিনির মধ্যে দেড় লাখ টনের বেশি এখনো বন্দরে ভাসছে। ঋণপত্রের জটিলতায় খালাসে বিলম্ব হচ্ছে।

সংকটের সময় আমদানি করা চিনি যখন কারখানায় নেওয়া হচ্ছে, তখন উৎপাদনেও হিমশিম খাচ্ছেন উৎপাদকেরা। কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি এই সংকট কিছুটা কমলেও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় প্রতি কেজি চিনিতে দুই টাকা বাড়তি খরচ হবে বলে দাবি তাদের।

বিশ্ববাবাজরে চিনির দাম গত বছরের শেষ দিক থেকে বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা যখন চিনির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন, তখন বিশ্ববাজারে প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে চিনির দাম।

যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য লেনদেনের বাজার শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের (সিবিওটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৭ মাসের মধ্যে এখন চিনির দাম সর্বোচ্চ। মার্চে সরবরাহ হবে এমন চিনি প্রতি পাউন্ড ২০ দশমিক ৪৬ সেন্ট। টনপ্রতি দাম পড়ে ৪৫১ ডলার। এই দামের সঙ্গে জাহাজভাড়া, বিমাসহ আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত হবে। চার মাস আগে এই দাম ছিল ৬২ ডলার কম, টনপ্রতি ৩৮৯ ডলার।

চিনির বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। ডলারের দাম বাড়ার কারণে টাকায় একদিকে আমদানি খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে ডলারের বাড়তি বিনিময়মূল্য ধরে কাস্টমস শুল্কায়ন করছে। তাতে শতাংশ হারে কয়েক মাসের ব্যবধানে শুল্ককরও বেড়েছে প্রতি কেজিতে সাত থেকে আট টাকা।

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়ায় প্রতি কেজিতে করভার ৩০ শতাংশ বেড়েছে। নতুন দামে যেসব চিনি খালাস হচ্ছে, সেগুলোতে এখন প্রতি কেজিতে ৩০-৩২ টাকা শুল্ককর দিতে হচ্ছে।

সরবরাহ বাড়ানো জরুরি : সামনে রোজা আসছে। সময় আছে দুই মাস। এ সময়ে চিনির সরবরাহও কম। এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চিনির দাম বাড়ায় মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। চাপ কমানোর জন্য শুল্ক সমন্বয়, বাজারে সরবরাহ বাড়াতে যেসব সমস্যা রয়েছে তা দূর করা এবং কেউ কৃত্রিম সংকট বা কারসাজি করছে কিনা, তাতে নজরদারি বাড়ানো দরকার। ডলার সংকটে বন্দরে যেসব চিনি খালাসে বিলম্ব হচ্ছে, তা দ্রুত সমাধান করলে বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়বে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close