নিজস্ব প্রতিবেদক ও সিলেট প্রতিনিধি

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাস

স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ

* বিক্ষোভে উত্তাল নগরী * ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা * তদন্তে কমিটি, বন্ধ ছাত্রাবাস ফের বন্ধের নির্দেশ

করোনা মহামারির মধ্যেই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা ঘটল। গত শুক্রবার রাতে এমসি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে নিজেদের গাড়িতে বসে গল্প করছিলেন ওই স্বামী-স্ত্রী। পাঁচজন যুবক তাদের গাড়িটি ঘিরে ধরে তাদের নামান। তিনজন যুবক তরুণীকে টেনে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে নিয়ে যান। স্বামীকে গাড়িতে আটকে রাখেন দুজন। ঘণ্টাখানেক পর স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পান স্বামী।

অভিযোগ উঠেছে, করোনা পরিস্থিতিতে ছাত্রাবাস বন্ধ থাকলেও ওই কক্ষ ২০১২ সাল থেকে ছাত্রলীগের কক্ষ হিসেবে পরিচিত এবং ছাত্রলীগের একটি পক্ষের ছয় থেকে সাতজন কর্মী এ ঘটনায় জড়িত। ওই তরুণী বর্তমানে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিৎসাধীন। তার শারীরিক কোনো ঝুঁকি নেই। তবে তিনি মানসিকভাবে কিছুটা আতঙ্কিত বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুছুর রহমান। তিনি জানান, ওসিসির মাধ্যমে তার শারীরিক পরীক্ষা করা হবে। একটি পরীক্ষা ঢাকায় করানো হতে পারে। সে জন্য নমুনা পাঠানো হবে। পরে সব প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট বিভাগে হস্তান্তর করা হবে।

এদিকে ছাত্রাবাসে নিয়মিত করেছেন ওই তরুণীর স্বামী। এরা হলেন সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, অর্জুন লঙ্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুম।

মামলার এজাহারে সাইফুর রহমানের বাড়ি বালাগঞ্জে ও বর্তমান ঠিকানা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কের বাংলো উল্লেখ করা। শাহ মাহবুবুর রহমানের বাড়ি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বাগুনিপাড়া ও বর্তমান ঠিকানা ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের ২০৫ নম্বর কক্ষ, মাহফুজুর রহমানের বাড়ি কানাইঘাটের গাছবাড়ি গ্রামে, রবিউলের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় জগদল গ্রামে, অর্জুনের বাড়ি জকিগঞ্জের আটগ্রাম এবং তারেকের বাড়ি সুনামগঞ্জ শহরের নিসর্গ আবাসিক এলাকায় (হাসননগর)।

কলেজ সূত্র জানায়, সাইফুর, রনি ও মাহফুজুর ইংরেজি বিভাগের স্নাতক শ্রেণির অনিয়মিত শিক্ষার্থী। অর্জুন সাবেক শিক্ষার্থী। রবিউল বহিরাগত। এরা ছাত্রলীগের কর্মী ও টিলাগড়কেন্দ্রিক একটি পক্ষে সক্রিয়। এর মধ্যে প্রধান আসামি সাইফুর রহমান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক রণজিৎ সরকারের অনুসারী। এ ব্যাপারে রণজিৎ সরকারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে সিলেট নগরী।

শনিবার দুপুরে এমসি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ধর্ষকদের গ্রেফতারের দাবিতে কলেজ গেটে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সিলেট-তামাবিল সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হয়। একই দাবিতে চৌহাট্টায় আরেকটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়।

ধর্ষণের ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে আগে থেকেই বন্ধ ছিল এই ছাত্রাবাস। বন্ধ ছাত্রাবাসে কীভাবে এমন একটি ঘটনা ঘটল, এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যে ‘বন্ধ’ ছাত্রাবাস আবার বন্ধের নির্দেশ এলো। গতকাল দুপুরে ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ কক্ষ তালাবদ্ধ। এর মধ্যে কয়েকটি কক্ষ থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীদের মালপত্র নিয়ে চলে যেতে দেখা গেছে।

কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ উদ্দিন জানান, কলেজের ?গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জীবন কৃষ্ণ আচার্র্য ও একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সাত কার্য দিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে ছাত্রাবাসের দুই নিরাপত্তা কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এমসি কলেজের একজন শিক্ষক ও ছাত্রাবাসের পাশের আবাসিক এলাকার দুজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্বামীর চিৎকার শুনে বালুচর এলাকা থেকে লোকজন ছাত্রাবাসের দিকে নজর রাখছিলেন। একপর্যায়ে নারী কণ্ঠের চিৎকার শুনে পার্শ্ববর্তী স্টাফ কোয়ার্টার থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে দেখতে পান। ছাত্রাবাস ফটকের সামনে তখন তাদের গাড়িটি ছিল। এক পাশে একটি মোটরসাইকেল রাখা দেখে স্থানীয় লোকজন শাহপরান থানায় খবর দেন। পুলিশ পৌঁছালে স্বামী-স্ত্রী ঘটনার বর্ণনা দেন।

তরুণীর স্বামী পুলিশকে জানান, যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন তারা সংখ্যায় পাঁচ থেকে ছয়জন ছিলেন। এর মধ্যে দুজনকে তিনি এমসি কলেজ ও ছাত্রাবাসে আগে দেখেছেন। এই দুজন তাকে নিজের গাড়িতে আটকে রেখেছিলেন। তিন থেকে চারজন তার সামনে স্ত্রীকে টেনে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকে নিয়ে যান। ঘণ্টাখানেক পর ওই তিন যুবক দৌড়ে চলে যাওয়ার সময় তাকে জিম্মি করে রাখা দুই যুবকও পালিয়ে যান।

এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ বলেন, রাতে শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে একদল পুলিশ ছাত্রাবাসে প্রবেশের অনুমতি চায়। আমি তখন ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কসহ স্টাফ কোয়ার্টারে বসবাসরত দুজন শিক্ষককে সঙ্গে কথা বলে পুলিশকে ছাত্রাবাস এলাকায় প্রবেশ করার অনুমতি দিই। কিছুক্ষণ পর জানানো হয়, সেখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ খবর পেয়ে র‌্যাবকে খবর দিই।

তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে ছাত্রাবাস বন্ধ। শুনেছি নেতারা (ছাত্রলীগ নেতা) সেখানে ছিল। এর বাইরে আর কিছু আমি জানি না। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশ ও র‌্যাবকে বলেছি।

১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এমসি কলেজ দেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নগরের টিলাগড় এলাকায় ৬০০ শতক জায়গার ওপর ১৯২০ সালে ব্রিটিশ আমলে আসাম ঘরানার স্থাপত্যরীতির ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের জেরে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছিল ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর পুনর্নিমিত ছাত্রাবাস উদ্বোধন করা হয়। এরপর থেকে ছাত্রলীগই এককভাবে ছাত্রাবাসে ছাত্রদের বসবাস নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও এমসি কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। সিলেটে জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটিও কেন্দ্র থেকে স্থগিত রয়েছে। গত বছরের ৬ আগস্ট রাতে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের কয়েকটি কক্ষ ও নতুন ভবন দখল তৎপরতার মুখে সর্বশেষ ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। তবে করোনা পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চ থেকে ছাত্রাবাস বন্ধ থাকলেও ছাত্রাবাসের ওই কক্ষ ২০১২ সাল থেকে ছাত্রলীগের দখল করা কক্ষ হিসেবে পরিচিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close