জুবায়ের চৌধুরী

  ১৭ জানুয়ারি, ২০১৯

নজর সড়ক শৃঙ্খলায়

ফের ডিএমপির অভিযান * যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা * দোকানিদের দখলে ফুটপাত

কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার সামনের সড়কে তখনো সিগন্যাল পড়েনি। বাংলামোটর থেকে ধেয়ে আসছিল বেশ কয়েকটি বাস, অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি। এরই মধ্যে কয়েকজন পথচারী দৌড়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছিলেন। এ যাত্রায় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও এভাবেই কিন্তু ঘটে যায় অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা। শুধু মানুষের যত্রতত্র পারাপারই নয়, যেখানে-সেখানে থামছে বাস। ইচ্ছামতো সড়কের ওপরই তোলা হচ্ছে যাত্রী। মানুষও দৌড় দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বাসে ওঠানামা করছে। আর এসব ঘটছে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই।

এদিকে, সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে ডিএমপির অভিযানের দ্বিতীয় দিনে শাহবাগ, বাংলামোটর, ফার্মগেট, বিজয় সরণিসহ বিভিন্ন এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। পাশাপাশি সড়কগুলোয় পথচারী ও চালকদের সচেতনতায় কাজ করে পুলিশ। পুলিশ বলছে, অভিযানের ফলে রাস্তায় আইন মানার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। পুলিশের পাশাপাশি সড়কে স্কাউট সদস্যরাও কাজ করছেন। পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করেন। তবে ট্রাফিক পুলিশ নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে জানালেন, মানুষ সচেতন না হলে শুধু আইন দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে ১৫ দিনের ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ। চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।

পান্থপথ সিগন্যালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্য ও ঢাকা কলেজের

শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে মানুষ সচেতন নয়। কখন রাস্তা পার হতে হবে অনেকে জানে না। জেব্রাক্রসিং দিয়ে পারাপার হতে বললে অনেকে বলেন, জেব্রাক্রসিং কোনটা একটু দেখিয়ে দেন। আবার অনেক সময় বাসগুলো জেব্রাক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়ায়। এতে মানুষ বিশৃঙ্খল হয়ে রাস্তা পারাপার হয়। বাসগুলো নির্দিষ্ট স্থানে না দাঁড়ানো সড়কের অন্যতম সমস্যা বলে মনে করেন আবদুল্লাহ।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের পর তড়িঘড়ি করে নানা উদ্যোগ নিয়ে সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা আনা গেলেও তা টেকসই হয়নি। ফলে দুর্ঘটনাও কমেনি, ঝুঁকি রয়ে গেছে পদে পদে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে। থামছে না মৃত্যুর মিছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আইনকানুন মানছে না বলেই সড়ক-মহাসড়কে নানা নৈরাজ্য চলছে। অদক্ষ চালকের অবহেলা, অত্যধিক যাত্রী বহনের মাত্রাতিরিক্ত বাণিজ্যিক প্রবণতা, সর্বোপরি বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, সড়কের সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গাড়ি, বেপরোয়া গতি ও ওভারটেকিংয়ের কারণেই সড়কে মৃত্যুর ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না।

গত জুলাইয়ে বাসচাপায় রাজধানীর শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের পর আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। কোমলমতি শিশুদের দেখানো পথে কিছুদিন হাঁটা শুরুর পর আবার চিরচেনা রূপ রাজধানীর সড়কে। বেড়েছে বাসের ওভারটেকিং, বন্ধ হয়নি পথচারীদের হাত দেখিয়ে রাস্তা পারাপার। শুধরায়নি কেউ, শৃঙ্খলা ফেরেনি রাজপথে। আলোচিত সেই দুর্ঘটনার পর আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা দুই মাসের বিশেষ অভিযান চালায় পুলিশ। তখন সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছিল। তবে একাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় অভিযানে বিরতি আসে।

রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা আনতে গত মঙ্গলবার ভোর থেকে ১৫ দিনের অভিযান শুরু করেছে ট্রাফিক পুলিশ। তবে এ শৃঙ্খলা আনা যে কঠিন কাজ, তা গুলিস্তানে বেলুন উড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের অভিযান উদ্বোধন করার সময়ও স্পষ্ট হয়। তখন সেখানে ও আশপাশের সড়কে সতর্ক ট্রাফিক পুলিশের সামনেও বেপরোয়া ছিল পরিবহনচালকরা। অভিযানের মধ্যে প্রথম দিনে ‘বাস স্টপেজে’ বাস থামেনি, থেমেছে আগে-পিছে। পথচারীরা ইচ্ছেমতো দৌড়ে রাস্তা পার হয়েছে। মোটরসাইকেল চলেছে ফুটপাতের ওপর দিয়ে। কোনো কোনো স্থানে দরজা বন্ধ রেখে বাস চলাচল করেছে। তবে মোটরসাইকেলে হেলমেট ব্যবহার বেড়েছে।

এদিকে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশ শুধু নয়, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সংশ্লিষ্ট ৩২ সংস্থার সমন্বয়ে কর্মসূচি নিতে হবে। স্কাউটসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে পথে পথে। এ জন্য ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) পুরস্কার প্রদান, প্রণোদনা দানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ও নৈরাজ্য বন্ধে পুলিশের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য সংস্থাও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়েছে যৎসামান্য। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া নির্দেশনাগুলোও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলাও ফেরেনি। মামলা ও জরিমানা দেদার হলেও সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে পুলিশ যেসব উদ্যোগের কথা বলেছিল, সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

চালকদের দাবি, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে যাত্রীদেরও সচেতন হতে হবে। সড়কের মাঝখানে তারা থামাতে চান না গাড়ি। কিন্তু যাত্রীরা দৌড়ে এসেই উঠে যায় বাসে। ছাত্র আন্দোলনের পর থেকে অনেকটাই সাবধান তারা। প্রভাতি পরিবহনের চালক বলেন, ‘আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা ইচ্ছা করে নিয়ম ভাঙতে চাই না। যাত্রীদেরও অসচেতনতা রয়েছে।’ বনশ্রী পরিবহনের চালক বলেন, ‘খালি মামলা করলেই হবে? রাস্তার চার লেন নিশ্চিত করতে হবে। যত্রতত্র রিকশা চলা বন্ধ করতে হবে। যেখানে-সেখানে রিকশা স্ট্যান্ড রাখা যাবে না। ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতিও বন্ধ করতে হবে।’ দায়িত্বরত একজন পুলিশ সার্জেন্ট বলেন, ‘লাইসেন্সবিহীন যানবাহন এবং আইন অমান্য করে গাড়ি চালানোর অপরাধে মামলা দেওয়া হয়েছে। তবে আগের তুলনায় সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। তদারকি অব্যাহত থাকলে সড়কের শৃঙ্খলা ফিরবে।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, গণপরিবহন ব্যবস্থায় সিটিং সার্ভিস নামে আলাদা কোনো সেবার কথা বলা নেই। তবু রাজধানীর প্রায় ৮৭ শতাংশ গণপরিবহন যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে থাকে। অনিয়ম চললেও সুরাহা নেই। এসব সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন সময় সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান জানান, গণপরিবহনে অনিয়ম দূর করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছে। অনিয়ম চোখে পড়লেই জরিমানা কিংবা দ- দেওয়া হচ্ছে। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক, এটি সবারই চাওয়া।

মামলা-জরিমানাতেই সীমাবদ্ধ পুলিশ : মামলা-জরিমানা করেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোয় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না তাদের। দফায় দফায় অভিযানের নামে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলা-জরিমানাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। অনেকেই বলছেন, এভাবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো অসম্ভব। তবু গৎবাঁধা সেই কাজই করছে পুলিশ। জানা গেছে, গত মঙ্গলবার শুরু হওয়া ট্রাফিক কার্যক্রমের প্রথম দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ৬ হাজার ৯০৯টি মামলা ও ৩৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। এ ছাড়া অভিযানে ৩৮টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৮৮৯টি গাড়ি রেকার করা হয়।

ট্রাফিক বিভাগ জানায়, উল্টোপথে গাড়ি চালানোর কারণে ১২৯০টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা, হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করার দায়ে ২১৮টি, হুটার ও বিকনলাইট ব্যবহার করার জন্য ১১টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা, মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস ব্যবহারের কারণে ২৩টি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে আইন অমান্য করার দায়ে ২৭৬৮টি মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে মামলা ও ১৩৯টি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়। সেই সঙ্গে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করার অপরাধে চালকের বিরুদ্ধে ২৬টি মামলা দেওয়া হয়।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের এই বিশেষ কার্যক্রম চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। মহানগরীর ৫৭টি স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে ট্রাফিক বিভাগ তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। রেড ক্রিসেন্ট সদস্যরা ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতা করছেন। পরে রোভার স্কাউট ও বিএনসিসিকে সংযুক্ত করা হবে। গত বছর তিন দফায় ট্রাফিক শৃঙ্খলা কার্যক্রম পালন করে ডিএমপি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close