অলোক আচার্য

  ২১ আগস্ট, ২০১৭

নিবন্ধ

সেলফি : শখ থেকে মৃত্যু

এখন যদি বহুল ব্যবহৃত শব্দের কোনো তালিকা হয়, তাহলে সেলফি শব্দটি খুব সম্ভবত প্রথম সারিতে থাকবে। এর জনপ্রিয়তা এখন এতই যে, শহর থেকে পল্লী, ছেলে থেকে বৃদ্ধ সবাই সেলফি তুলতে ব্যস্ত। হাত-পা বাঁকিয়ে নিজের মুখ এদিক সেদিক করে রীতিমতো কসরত করে হাত দিয়ে অথবা সেলফি স্টিক দিয়ে সেলফি তুলতে দেখা যায়। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই তার পেছনের ইতিহাস লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়া হয়। বলা যায়, সেলফি রীতিমতো ভাইরাসের মতো মাথার ভেতর ঢুকে গেছে। সেই ভাইরাস আরো ভাইরাস জন্ম দিচ্ছে। এক সময় তা অস্থি মজ্জায় ছড়িয়ে গিয়ে নেশায় পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বে ক্রমেই এই প্রবণতা বেড়ে চলেছে। বিষয়টি যদি কেউ কেবল নিজের ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে কোনো কথা ছিল না। শেষ পর্যন্ত তা তো আর থাকছে না। কোনো অবস্থাতেই সেই সেলফি তোলা থেকে আমরা এক বেলা বা এক দিনও বিরত থাকতে পারি না। সেলফি তুলতে গিয়ে এতটাই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছি যে, স্থান-কাল-পাত্রভেদ সব গুলিয়ে একাকার করে ফেলছি। স্টাইলিস্ট পরিচয় দিতে গিয়ে নিজেকে নিতান্তই আহাম্মক পরিচয় দিচ্ছি।

অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও এই বিষয়টির এত পরিচিতি ছিল না। এটা ঠিক, সেলফি কেবল বাঙালিদের মাথার ভেতরই জায়গা দখল করেনি, বরং সারা বিশ্বের মানুষের মাথাই খারাপ হওয়ার জোগাড় সেলফির দাপটে। এখন কোনো বড় বা ছোট অনুষ্ঠানে গেলে সেখানে রীতিমতো সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কে বর কনের সঙ্গে সেলফি কিভাবে তুলতে পারছে, কোন টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে সবকিছুর সেলফি আপডেট সবার আগে আর ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। কারো আমন্ত্রণে গিয়েও আমরা সেখানে নিজ দায়িত্ব ভুলে গিয়ে সেলফি আপডেট পাঠাতে থাকি। কার সেলফি কত ভালো ওঠে সে নিয়ে গবেষণা আরম্ভ হয়। তারপর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করা হয়। একের পর এক লাইক, কমেন্টস পড়তে থাকে। যুগ তো এখন এই লাইক কমেন্টসে আটকে আছে। দেখা যায়, কোনো নেতার অনুষ্ঠানে গিয়ে সেই নেতার সঙ্গে সেলফি পোস্ট করাই মূল উদ্দেশ্য। নেতার ইচ্ছা না থাকলেও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের মুখ চেয়ে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু সেলফি অত্যাচার সহসাই শেষ হয় না। এই সেলফি তুলতে গিয়ে কিন্তু বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। এই মৃত্যুর হার আবার ভারতেই বেশি। সেখানে সেলফিতে মৃত্যুর হার সারা বিশ্বের সেলফি মৃত্যুর ৬০ ভাগ। বহু সেলফি প্রিয় তরুণ-তরুণী সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। এক জরিপে দেখা যায়, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ১২৭ জন সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণ হারায়। এর মধ্যে ভারতেই ৭৬ জন। তারা জানত সে কাজে ঝুঁকি আছে, তার পরও তারা সেলফি তুলতে গেছে। এর ফল হয়েছে মৃত্যু।

এখন যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেলফি তুলতে যায় তারা নেহায়েত শখের বশেই যায়Ñএমনটা বলা ঠিক হবে না। কারণ মানুষ শখের বশে মৃত্যুকে বরণ করতে চায় না। আসলে সেলফি বিষয়টি একটি প্রেস্টিজ ইস্যুর মতো দাঁড়িয়ে গেছে। যে যত আলাদাভাবে সেলফি তুলতে পারবে তার তত বেশি লাইক পড়বে। তা সে সাপের মুখের কাছেই হোক আর কুমিরের মুখের সামনেই হোক। যত আলাদা সেলফি পোস্ট হবে তাকে তত বেশি বাহবা দেয়। কিন্তু এই বাহবা যে কেবল বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এটার জন্য জীবনের ঝুঁকি নেওয়া যায় না, তা কে বোঝাবে এদের। তাই সেলফি তুলতে গিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। বাড়ছে সেলফি তোলার নতুন নতুন উপায়। এখন পর্যন্ত চলন্ত ট্রেনের সামনে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে, কুমিরের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে, প্লেন থেকে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে, সিংহের খাঁচার সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে, সাপের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে কামড়ে মৃত্যু হয়েছেÑ এ রকম অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সেলফি তুলতে গিয়ে। এগুলো কেবল ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছুই নয়। বিজ্ঞানের সুবিধা নিতে গিয়ে আমরা হারিয়ে ফেলছি মানবিকতা। মানবিকতা থাকলে তো আর মৃত মানুষের সামনে বসে সেলফি তোলার রুচি হতো না। খাদিজাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে দর্শনার্থী নেত্রীর সেলফি ভাইরাল হয়েছিল। আবার এক দেশে পেছনে বোন প্রসূতির যন্ত্রণায় ছটফট করছে সামনে অন্য বোন সেলফি তোলায় ব্যস্ত। এ রকম বহু ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। যেখানে আবেগের কোনো দাম নেই। আছে কেবল নিজেকে পরিচয় করানোর মিথ্যে প্রতিযোগিতা। এসব সেলফি তুলে কেউ বন্ধুদের লাইক পেয়েছে, কেউ কমেন্টস পেয়েছে, কেউ আহত হয়েছে আবার কেউ বা মারা গেছে। যুগটা কেবল লাইক আর কমেন্টসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। কোন পোস্টে কয়টি লাইক পড়ছে তাই দিয়ে তার জনপ্রিয়তা যাচাই করা হয়। এরা নাকি ফেসবুক হিরো। এসব হিরোদের জন্য আজকাল আবার ফেসবুক এক্সপার্ট দেখা যায়।

এবার সেলফি নিয়ে নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। সেলফি তুলতে গিয়ে একজন বিখ্যাত মানুষকে কী পরিমাণ বিরক্ত হতে দেখেছিলাম সেই কথা। অনুষ্ঠানটি ছিল গানের। মূল অনুষ্ঠান শেষে দেশের প্রখ্যাত এক গায়ক গিটার হাতে গান গাওয়ার জন্য মঞ্চে উঠলেন। দর্শকদের আরো কাছ থেকে গান শোনানোর জন্য তিনি দর্শকদের কাছে এসে গান গাইতে শুরু করলেন। গান শুরু করার পরপরই এক বিচিত্র দৃশ্য দেখা গেল। সেখানে আসা বেশ কিছু উঠতি বয়সী মেয়ে, বউ, ছেলে-ছোকরা মোবাইল নিয়ে এগিয়ে গেল। একের পর এক বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন স্টাইলে সেলফি তুলতে আরম্ভ করল তারা। বেচারা গায়কের তখন মুখের চেহারা দেখে আমার মায়াও লাগছিল। এক সময় বাধ্য হয়েই সেলফি প্রিয়দের অত্যাচারে গান শেষ না করেই তিনি মঞ্চ ত্যাগ করলেন। এই হলো আমাদের অবস্থা। স্থান-কাল-পাত্রভেদ সব ভুলে বসে আছি। চারদিকে কেবল সেলফি আর সেলফি। আজ থেকে বছর দশেক পিছিয়ে গেলেই এসব লাইক কমেন্টসের ভূত কারো মাথায় পাওয়া যেত না। বিজ্ঞান এগিয়েছে, আমরা এগিয়েছি, কিন্তু মানবতা পিছিয়েছে কি? আজকাল দেশে বিদেশে সেলফি নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছে। সেলফি কনটেস্ট নাম দিয়ে সেসব প্রতিযোগিতা হচ্ছে। অনেক পত্রিকাতেও সেলফি বিভাগ আছে। তার মানে দাঁড়ায় সেলফি সর্বত্র। সেলফি কোনো সন্দেহ নেই নিজের প্রতি আমাদের যতœ বাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতেও অক্ষম করে তুলছে। এটা নিশ্চয়ই ভালো কথা নয়।

সেলফি নিয়ে এতক্ষণ কেবল নেতিবাচক দিক নিয়ে বললাম। এমন নয় যে, এর কোনো ভালো দিক নেই। বিজ্ঞানের সূত্রের মতোই এখানেও প্রতিটি বিষয়ের ভালো এবং খারাপ দিক দুটোই আছে। সেলফিরও আছে। সেলফির জন্যই আজ কোথাও কোনো প্রিয় বন্ধুটি কী করছে তা জানতে পারছি। তাকে শুভ কামনা জানাতে পারছি। কে কবে কখন কোথায় প্রথম সেলফি তোলার এই অভ্যাসটা শুরু করেছিল তা এখন আর নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে একটি তথ্য বলছে, প্রথম যে ব্যক্তি নিজেই নিজের ছবি তুলেছিল তাও প্রায় ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। সেই সেলফি তোলা মানুষটি তার প্রতিদিনকার ছবি তুলে সংরক্ষণ করত। এসব তো একটা ভালো দিক। তবে সেলফি কাজে লাগিয়ে আজকাল অন্যকে মানসিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার পরিমাণও কম নয়। ক্রমেই এই সংখ্যা বাড়ছে। আবার এমন কারো সঙ্গে সেলফি তুলছি পরবর্তীতে সে ছবি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে। এই নিয়ে দেশে হইচই পড়ে যাচ্ছে। তাই বলছি সেলফি নামক এই অতি আধুনিক রোগটি আামদের ভালোর থেকে মন্দই বেশি করছে। বৈশ্বিক যুগে বিষয়টি এমন নয় যে, কেউ কাউকে হাতে ধরে বুঝিয়ে দেবে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। কোনটা করা উচিত আর কোনটা উচিত নয়। ইট, কাঠ আর পাথরের শহরে মন আজ বন্দি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পর্দায়। সেখানেই নিজেকে হিরো প্রমাণ করার এক ব্যর্থ চেষ্টা করা হয় সেলফির মাধ্যমে। আবেগ থেকে যে জ্ঞানশূন্যতার জন্ম হয় তার ফল ভালো হয় না। তাই সেলফির বিষয়টি আজকাল আর ভালোতে থাকছে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist