এস এম মুকুল

  ১৮ আগস্ট, ২০১৭

ভালোমন্দ

সমকালের কড়চা

বন্যার বিস্তার আছে নিস্তার নেই : ভয়াল রূপ নিচ্ছে বন্যা। পানি বাড়তে শুরু করেছে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোতেও। ক্রমেই মধ্যাঞ্চলের দিকে বিস্তৃত হচ্ছে বন্যার পানি। উত্তর ও উত্তর-পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চলের প্রায় ৩০ জেলায় লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সড়কপথ, রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। উত্তরাঞ্চলে ২৩টি স্থানে বন্যা রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। বড় বিপর্যয়ের সম্মুখে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) তিন বছর আগে এবং দুই বছর আগে বিশ্বব্যাংক আলাদা একটি গবেষণায় দেখিয়েছিল এমনকি অতিবৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ দেখে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে আগাম পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল এবারের বর্ষা মৌসুমের শুরুতে মধ্য আগস্টে বড় ধরনের বন্যার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে দেশ।

মন্তব্য : ২০১৭ বছরটাই যেন বিপর্যয়ের। প্রথমে হাওরে অকাল বন্যায় ফসলডুবি, পরে ধানের মড়কে ফসলের ক্ষতি, এরপর পাহাড়ধস সবশেষে ধেয়ে এলো বন্যার বড় বিপর্যয়। একটি ব্যাপার মাথায় ধরছে না, সরকার কি কোনো পূর্বাভাসই আমলে নেয় না!

কথা হচ্ছে, এসব আমলে নিলেই বন্যা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকানো যেত কি না, তা ভিন্ন বিষয়। যথেষ্ট প্রস্তুতি তো থাকতে পারত। আমাদের ত্রাণ মন্ত্রণালয় আর খাদ্য মন্ত্রণালয় তো হাওরের বিপর্যয়ই সামলাতে পারেনি। চালের দাম আকাশে উঠেছে। এখন এত বড় বন্যার বিপর্যয় কিভাবে সামাল দেবে, সেটাই ভাবার বিষয়। সামনে কোরবানির ঈদ। অতিবৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা হয়েছে। ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের ভোগান্তি কোন পর্যায়ে যাবে আল্লাহ মালুম। প্রকৃতির ওপর মানুষের হাত নেই, তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের এ দুটি মন্ত্রণালয়ই চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এখন ত্রাণ দিয়ে কতটা পরিত্রাণ মিলবে, কে জানে। এখন অভিযোগ না তুলে নিজেদের দায়িত্ববোধে মনোযোগ দিলেই প্রমাণ হবে কার ভূমিকা কোথায়। সরকার তো বটেই, বিরোধী দল, সামাজিক সংস্থা ও সংগঠন এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ে দ্রুততম সময়ে বানভাসিদের জন্য ত্রাণসহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়ানো দরকার। বন্যার ধকল কাটালে ৬ মাস লাগবে। দেখা দেবে অসুখ আর বিশুদ্ধ পানির সংকট। দরকার হবে পুনর্বাসনের। সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ দেখতে চায় জনগণ। এমপি সাহেবরা যেভাবে ভোট ভিক্ষা চেয়ে জিতেছেন, সেভাবে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। শোক দিবসের কাঙালি ভোজের আয়োজনে অধিক মনোযোগী হওয়ার কারণে বন্যার পরিত্রাণে সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি ও কর্মীদের মনোযোগ কম ছিল বলেও বাস্তবসম্মত মতামত দিয়েছে বিভিন্ন মহল। এই কাঙালি ভোজটি এবার বন্যার্তদের জন্য সহায়তায় কাজে লাগালে অধিক উপকার হতে পারত। যাই হোক না কেন, বড় বিপর্যয় সামলাতে সরকারের পাশে বিরোধী দল, সামাজিক সংস্থা এমনকি ধনাঢ্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের জনগণের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

কোরবানি হোক দেশি পশুতে : আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য এ রকম প্রায় সোয়া এক কোটি পশু কেনাবেচার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। দেশি গরুতেই ভরসা রাখার আহ্বান জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। যুব উন্নয়ন অধিদফতর ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ প্রশিক্ষণ নিয়ে এর মধ্যে হাজার হাজার বেকার তরুণ স্বাবলম্বীও হয়েছেন। জানা গেছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, এবারও কোরবানির পশুর কোনো সংকট হবে না। সারা দেশে এখন গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া রয়েছে পাঁচ কোটি ৪৭ লাখ ৪৫ হাজার। দেশি পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। কেননা কোরবানিতে সারা দেশে পশুর চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ এক কোটি ১০ লাখ।

মন্তব্য : ভারতীয় আগ্রাসনে দেশি পশুসম্পদ আর মাংসের বাজার অস্থির হয়ে উঠার দিন বুঝি শেষ হতে যাচ্ছে। কারণ দেশে গো-মাংস এবং কোরবানির চাহিদাপূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। এ বছর আশা করা হচ্ছে, দেশীয় পশুতেই মিটবে কোরবানি চাহিদার ৯৬ শতাংশ। ভারত গরু রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে ২০১৪ সাল থেকেই কোরবানির পশুর চাহিদা দেশীয়ভাবে মেটাতে বাড়তি পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ সরকার। বিএসএফের নির্বিচার গুলি আর অত্যাচার সীমান্তের মানুষদের চোখ খুলে দিয়েছে। সীমান্তসংলগ্ন গ্রাম ছাড়াও মফস্বল অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামের সচ্ছল ও অস্বচ্ছল প্রতিটি পরিবারেই গরু পালন করা হচ্ছে। কথা হচ্ছে আমরা গো-মাংসের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের ইচ্ছার কাছে জিšি§ হয়ে থাকতে পারি না। ভারতের এই গরুমি খেলা আমরা চাইলেই বন্ধ করতে পারি। আসুন কোরবানির জন্য আমরা সবাই দেশীয় গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগলকে প্রাধান্য দিই। প্রথম কয়েক বছর দাম একটু বেশি হলেও অচিরেই দেশে গবাদিপশুর খামারিরা গবাদিপশু উৎপাদনকে চাহিদার চেয়ে উবৃত্ত পর্যায়ে উন্নীত করতে পারবেন। আর তখন আরো কম দামে কোরবানির পশু এবং সারা বছর মাংসের চাহিদা ঢের পূরণ হবে। কোরবানির পশু কেনার ক্ষেত্রে দেশীয় পশুকে অগ্রাধিকার দিলে এর সুফল পাব আমরাই। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ভারত থেকে গরু আমদানি বাবদ প্রতিবছর ৬০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় অথচ গরু-মহিষ লালন-পালনের কাজে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করলে দেশের চাহিদা পূরণ করে মাংস ও পশুর বর্জ্য রফতানি করে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানো যায়। সরকার ও সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ব্যাপারটি ভাবছেন।

বিদেশিদের ফাঁদে স্বদেশি : দেশে মাদক, জাল মুদ্রার ব্যবসা ও প্রতারণার ফাঁদসহ নানামুখী অপরাধে জড়াচ্ছে বিদেশিরা। ভিনদেশি অপরাধী চক্র প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব বিদেশি বাংলাদেশে ব্যবসা কিংবা ভ্রমণের কথা বলে প্রবেশ করে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। জানা গেছে, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, আলজেরিয়া, আইভরিকোস্ট, সেনেগাল, ক্যামেরুন, সুদান, তানজানিয়া, কঙ্গো, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, লাইবেরিয়ার নাগরিকরা অপরাধে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। তাদের সহায়তা করছে এ দেশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং দালাল। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় অবৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশিদের বসবাসের সুযোগ দিন দিন বাড়ছে।

মন্তব্য : খবর- ভয়ংকর! রাজধানীর বনশ্রী, উত্তরাসহ বেশ কিছু এলাকায় এই অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, খুব কম ক্ষেত্রে এই অপরাধীদের জনসমক্ষে আনা হয়। অপরাধী চক্র বিদেশি নাগরিকরা ব্যবসার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, মাদক, এটিএম বুথ জালিয়াতি, বিভিন্ন পুরস্কার ও লটারি জেতা এবং নকল বা জাল টাকা তৈরির মতো অপরাধমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে। তারা দেশীয় যেসব কর্মকর্তা ও দালালের সহায়তায় এসব কাজ করে বেড়াচ্ছে আগে ওদের ধরে নিপাত করা উচিত। জানতে ইচ্ছে করে, তাদের ভিসা দেওয়ার সময় ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় কি না। দেশে অবস্থানকালে তাদের গতিবিধি বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য ও নজরদারি কেন থাকে না। এসব অপরাধ নতুন নয়, কেন তাদেরকে আইনের মাধ্যমে কঠোর সাজা দেওয়া হয় না। ওই সব বিদেশের দেশে বাংলাদেশিরা গিয়ে কি এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে পারবে, পার পাবে। নিশ্চয়ই না। তাহলে আমাদের দেশের গোয়েন্দা পুলিশ কি করে-এমন প্রশ্ন জনগণের মনে আসতেই পারে বৈকি!

বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান : দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় এক কোটি টন। হিমাগার ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার দুস্থ ও দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের আলু দিতে পারে; এতে সরকারের টাকা সাশ্রয় হবে। চালের দাম হ্রাস পাবে। আলুচাষিরা উপকৃত হবেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বরাবরে চিঠিতে ভিজিএফসহ অন্য কর্মসূচিগুলোর আওতায় অর্ধেক আলু বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। হিমাগারে থাকা ৫৩ লাখ টন আলু ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্রি করতে না পারলে কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে যাবে। হিমাগারে আলু নষ্ট হয়ে যাবে।

মন্তব্য : খুবই ভালো প্রস্তাব। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, বাংলার কৃষক ১২ টাকা কেজি আলু বিক্রি করে ৪৭ টাকা কেজিতে চাল কেনেন। সরকার এ প্রস্তাবটিকে ইতিবাচকভাবে নিলে দেশের এক কোটি কৃষক আলুর প্রকৃত দাম পাবেন। তবে অবাক লাগছে, এখন আলু খেয়ে চালের দাম কমাতে হবে, এ কথা জেনে। ভালো খবরটি হচ্ছে, বাংলাদেশে আলু উৎপাদন বেড়েছে ২৬ গুণ। মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। তার পরও আলু নিয়ে এত অবহেলা কেন। আলুতে আছে শর্করা, ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’। আমরা খাদ্যতালিকায় আলুর বহুমাত্রিক ব্যবহারে উৎপাদনের সম্ভাবনাকে অর্থকরী করে তুলতে পারি যেমন-আলুর পরাটা, আলুর দম, আলুর মিষ্টি, আলুর হালুয়া, আলুর চিপস, ভর্তা-ভাজিতে আলু, আলুর ডাল, আলুপুরি, আলুর সিঙ্গারা, আলুর সমচা, আলুর রোল, আলুর নুডুলস প্রভৃতি। আলুর পাউডার তৈরি করা যেতে পারে, যা অন্য খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে। কোনো অবস্থাতেই কৃষকের কষ্টের এই বর্ধিত উৎপাদন যেন বিফলে না যায়, সেদিকে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। জনগণেরও সচেতনতা প্রয়োজন, নিত্যদিনের খাবারে আলুর ব্যবহার বাড়ান, উৎপাদিত বর্ধিত আলুকে কাজে লাগান।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist