রায়হান আহমেদ তপাদার
আন্তর্জাতিক
আল জাজিরা বন্ধের অপতৎপরতায় ইসরায়েল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নয়া বিশ্বব্যবস্থার অধীনে ইসরায়েলের প্রতিবেশী সব আরব দেশকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। প্রথমত, পশ্চিমা সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি, কৌশলগত সমরাস্ত্রের ভা-ার ইসরায়েলের জন্য উজাড় ও অবারিত করে রাখা হয়েছে। বহিরাগত ইহুদিদের নিয়ে গড়ে তোলা ক্ষুদ্র ইসরায়েল রাষ্ট্রটি গত সত্তর বছরে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যতবার যুদ্ধ করেছে, অন্য দেশের ভূমি দখল ও আগ্রাসন চালিয়েছে বিশ্বের অন্য কোনো সামরিক পরাশক্তি রাষ্ট্র তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে এমন আচরণের কোনো নজির নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা, কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ও সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার অবিমৃশ্যকারিতার পুনরাবৃত্তি রোধে বিশ্ব সম্প্রদায় জাতিসংঘের মতো সংস্থা গড়ে তুললেও ইসরায়েল এবং মার্কিনিদের কাছে শান্তিকামী বিশ্বের প্রত্যাশা যেন শুরু থেকেই জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির যে কোনো সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করাই যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের মূল লক্ষ্য। পশ্চিমা পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদের এই নীলনকশা বাস্তবায়নে ইউরোপ-আমেরিকার জায়নবাদী ইহুদি লবি এবং তাদের মালিকানাধীন করপোরেট মিডিয়াগুলো শতবর্ষব্যাপী একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ও মগজধোলাই কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। একচ্ছত্র বাণিজ্যিক স্বার্থের অন্তরালে বিজ্ঞাপনী সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্ব, মেইনস্ট্রিম প্রিন্ট মিডিয়া, অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেল এবং হলিউড, ডিজনিল্যান্ডের মতো প্রচার, প্রকাশনা ও বিনোদনের কেন্দ্রগুলোতে শত শত কোটি ডলারের যে করপোরেট বিনিয়োগ তার নেপথ্যে রয়েছে ইহুদিবাদী প্রোপাগান্ডা মেকানিজম।
গত বছর মার্চে ‘দ্য নিউ মাইন্ড কন্ট্রোল’ শিরোনামে রবার্ট এপিস্টেইনের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় আইসিএইচ অনলাইনে। সেখানে তিনি গত শত বছরে প্রকাশিত পশ্চিমা মাইন্ড কন্ট্রোল বিষয়ক সাহিত্যের একটি ধারাবাহিক নির্ঘন্ট তুলে ধরেন। সেখানে তিনি প্রথমেই মার্কিন লেখক জ্যাক লন্ডনের লেখা ১৯০৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আয়রন হিল’ গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে করপোরেট টাইটান বা টাইকুনরা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে, কিছু সংখ্যক উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিভাবান মানুষ অতি উচ্চ বেতনে তাদের স্বার্থে কাজ করছে, তারা আরাম আয়েশে বিলাসী জীবনযাপন করলেও নিজেদের জীবনের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা স্বাধীনতা নেই। করপোরেট টাইটানদের বাইরে সমগ্র মানব সভ্যতাই এক ধরনের ভার্চুয়াল দাসত্বের জালে বন্দি হয়ে পড়ার বাস্তবতা শত বছর আগে জ্যাক লন্ডনের লেখায়ই যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশলের ভিত্তি সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যেই নিহিত ছিল। তবে পরবর্তীতে এ ক্ষেত্রে অধিক গবেষণালব্ধ জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমীকরণের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এপিস্টেইন মার্কিন সাংবাদিক ভেন্স প্যাকার্ডের লেখা ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত ননফিকশন গ্রন্থ ‘দ্য হিডেন পারসোয়েডার্স’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। স্যাটেলাইট টেলিভশন চ্যানেল এবং ইন্টারনেটের প্রসারের মধ্য দিয়ে গণমানুষের যাপিত জীবন ও চিন্তাধারার বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ন্ত্রণের সেই কৌশল ক্রমশ আরো সর্বপরিব্যাপ্ত হয়েছে।
সিআইএ, মোসাদের মতো গোয়েন্দা সংস্থা, বিবিসি, সিএনএন, ফক্স নিউজ, স্টার চ্যানেল থেকে শুরু করে ডিজনিল্যান্ড, হলিউড, সাবলিমিনাল স্টিমুলেশন মেথড, ইয়াহু, গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ক্লাস অব ক্লানস, গেম অব থ্রোনস, স্টার ওয়ার্স, হ্যাট্টেট ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন ও ভিডিও গেমের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব থেকে বিশ্বের কোনো প্রান্তের কোনো মানুষই মুক্ত নয়। তারা সম্মিলিতভাবে পশ্চিমা পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে বিশ্বের সব মানুষের চিন্তাধারা ও রাষ্ট্রীয় আইনকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এর বাইরের কোনো স্বাধীন চিন্তাধারাকে তারা যে কোনো উপায়ে দমিত করার পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ক্ষুদ্র দেশ কাতার মাথাপিছু গড় আয় এবং জীবনমানের কিছু উপাত্তের দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাযেল বা সৌদি আরব থেকেও উন্নত। জিডিপি পার ক্যাপিটাল হিসেবে দেশটি বিশ্বের এক নম্বর ধনী রাষ্ট্র। দৃশ্যত পশ্চিমা ধনী রাষ্ট্রগুলোর জন্য এটা তেমন মাথাব্যথার কারণ না হলেও এই কাতারের দোহায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিছুটা স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সাহসী আন্তর্জাতিক নিউজ টিভি চ্যানেল আল জাজিরা। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক মেনিফেস্টোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে বলে তারা দাবি করে। যদিও তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, সামরিক প্রশাসন এবং করপোরেট মিডিয়া সা¤্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে না।
যুদ্ধের দুটি পক্ষ থাকলেও গণমাধ্যমগুলো মূলত একপাক্ষিক। এর পরও তারা এম্বেডেড জার্নালিজমের ন্যক্কারজনক ইতিহাস তৈরি করেছে। এ ছাড়া বিশ্বে এমন কোনো গণমাধ্যম গড়ে ওঠেনি, যারা নিজস্ব শক্তিতে পশ্চিমা যুদ্ধবাজ ও আগ্রাসী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রকৃত সত্য তুলে ধরবে। সেই অর্থে আল জাজিরা টিভি চ্যানেলকে যথার্থ স্বাধীন ও সক্ষম গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা না গেলেও কিছুটা ব্যতিক্রম ও ভিন্নমতের সহাবস্থান থাকায় আল জাজিরা পশ্চিমাদের জন্য কিছুটা হলেও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরব বসন্ত, সিরিয়া যুদ্ধ, আইসিল, ইয়েমেন যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের ওপর আল জাজিরার বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রভাব বেশ স্পষ্টভাবেই ধরা পড়েছে। এ কারণে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে আল জাজিরা সম্পর্কে তেমন কোনো জোরালো অভিযোগ না উঠলেও গত জুন মাসে যে পাঁচটি আরব দেশ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পাশাপাশি অবরোধ আরোপ করেছে, তারা তাদের ১৩ দফা শর্তের অন্যতম প্রস্তাব হিসেবে আল জাজিরা টিভি চ্যানেল বন্ধের দাবি জানিয়েছে। তারা আল জাজিরার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে উসকানি ও মদদ দেওয়ার অভিযোগ এনেছে। যদিও তাদের অভিযোগের সপক্ষে তারা কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি। অন্যদিকে কাতারে অবরোধ আরোপের পর কাতার তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক প্রস্তাবগুলোতে আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোনো আপস করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল।
কাতারে অবরোধ আরোপের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন সংকট সৃষ্টির পর ইসরায়েল প্রথমবারের মতো আল আকসা মসজিদে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। তারা নিরাপত্তার নামে আল আকসার প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর এবং সিসি ক্যামেরা বসায়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি বিশ্বের মুসলমানরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ইসরায়েলি পুলিশের রক্তাক্ত আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিনিদের সাহসী প্রতিবাদের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে আল জাজিরা। অবশেষে মেটাল ডিটেক্টর এবং ক্যামেরাগুলো সরিয়ে নিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয় ইসরায়েলিরা। গত এক দশকে গাজায় হামাস ও হেজবুল্লাহ সঙ্গে একাধিকবার যুদ্ধে পরাজয়ের পর এবার ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র মানুষের প্রতিবাদের কাছে একটি কৌশলগত যুদ্ধে হেরে গেল ইসরায়েল। আর এ জন্য আল জাজিরাকেই দায়ী করছে তারা। এ জন্যই ইসরায়েলে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরায়েল। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিবাদী সংগ্রাম এবং ইসরায়েলের নৈতিক পরাজয়কে যথার্থভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আল জাজিরা অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেছে। মধ্যপ্রাচ্য বা ফিলিস্তিনের স্বার্থে জিসিসি, ওআইসি, আরবলিগ, ওপেক বা পিএলও যা পরেনি প্রচারযুদ্ধে আলজাজিরা তা পেরেছে। এমনকি চীন বা রাশিয়াও মধ্যপ্রাচ্যে বিবিসি বা সিএনএনের প্যারালাল কোনো গণমাধ্যম সৃষ্টি করতে পারেনি। আর তাই ইসরায়েলের টার্গেট হওয়ার মধ্য দিয়েই আলজাজিরা তার সাফল্যের প্রমাণ রেখেছে।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
"