শিকদার মো. জিননুরাইন

  ২৮ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

প্রসঙ্গ : শিক্ষকের মর্যাদা

মূর্খতা অন্ধকারের শামিল। এই মূর্খতা দূরীকরণে সু-শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। যিনি শিক্ষা দান করেন তিনি শিক্ষক বা শিক্ষাগুরু। অন্যদিকে যিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি শিক্ষার্থী। অন্যভাবে বলা যায়, যে বা যিনি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত থেকে শিক্ষার্থীদের সু-শিক্ষাদান করেন তিনি শিক্ষক। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র পেশা শিক্ষকতা, যার পূর্বে মহান শব্দটি যুক্ত আছে। তাই সংগত কারণে-ই এই মহান পেশায় জড়িত ব্যক্তিদের মর্যাদা বা সম্মান একটু ভিন্নতর হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের প্রিয় ধর্ম ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মে উল্লেখ আছে, ‘তুমি জ্ঞানার্জন করো আদবের বা শিষ্টাচারের মাধ্যমে এবং যিনি তোমাদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করেছেন তাকে

সম্মান করো।’

ইউনেসকো ও আইএলও যৌথভাবে শিক্ষকের মর্যাদার একটি সনদ তৈরি করে, যা ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্মেলন গৃহীত হয়। এখানে শিক্ষকের মর্যাদা বলতে অন্য পেশাজীবীদের মতো শিক্ষকতা কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় তাদের সততা, যোগ্যতা ও পারদর্শিতার কারণে প্রদত্ত সম্মান ও আনুষঙ্গিক সুবিধাকে বোঝানো হয়েছে।

একজন স্বশিক্ষিত, প্রাজ্ঞ ও গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষক নিঃসন্দেহে সমাজের ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিতে পারে। একজন নীতিবান আদর্শ শিক্ষক সুন্দর সমাজ গঠনে সর্বাত্মক সহায়তা দিতে পারে। তাই এ কথা বলা প্রয়োজন, ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত আদর্শমানবরূপে গড়ে তোলার পেছনে বাবা-মায়ের চেয়ে শিক্ষকের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। শিক্ষক তার জ্ঞানের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মানবতা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনে করে তাদের নীতিনৈতিকতার আদর্শে জীবন গঠনে সহায়তা করে। ফলে শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কর্মময় জীবনকে সফলতার মুখ দেখাতে পারে এবং ফলে সমাজ-রাষ্ট্র সবাই উপকৃত হয়।

প্রাচীন ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার একটি ধারায় দেখা যেত গুরুগৃহে অবস্থান করে জ্ঞানচর্চা। যতদূর জানা যায়, গুরু বা শিক্ষকরা বনের ভেতরে কুটিরে বসবাস করতেন। সে কালের রাজা-বাদশাহরা সন্তানদের নিয়ে তাদের কাছে এসে করজোড়ে প্রার্থনা

জানাতেন তাদের সন্তানদের দায়িত্ব নিতে। রাজা-বাদশাহদের সন্তানরা গুরু সেবা করে জ্ঞানের দীক্ষা নিতেন। এখানেই শিক্ষকের মর্যাদার সুস্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। দিল্লির বাদশাহ আলমগীর ও তার পুত্র শিক্ষকের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। তার কাছে কোনো শিক্ষক দেখা করতে গেলে তিনি দাঁড়িয়ে সম্মান করতেন। এই তো মাত্র তিন/চার দশক আগেও অন্যের সন্তানকে প্রকৃত মানুষ করার আগ্রহ ছিল প্রতিটি শিক্ষকের মধ্যে। তারা শিক্ষকতা মহান পেশা এবং তাদের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করতেন। তাদের নীতি ও আদর্শ ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সে সময় শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশকারী ব্যক্তিদের ধ্যানজ্ঞান ছিল এক ধরনের নেশার মতো। তারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজের জ্ঞানটুকু বিলিয়ে দিতে খুবই আন্তরিক ছিলেন। তারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের খোঁজখবর নিতেন এবং কোনো আর্থিক সুবিধা ছাড়াই ছাত্রছাত্রীদের সমস্যার সমাধান করে দিতেন। সে সময় দেখা যেত শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকের দিকে মাথা উঁচু করেও তাকাত না। শিক্ষক মানে পরম পূজনীয়, আদর্শবান ব্যক্তিত্ব মনে করত শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থী জাতির মেরুদণ্ড এই মর্মবাণী সামনে রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শিক্ষার হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্র বা সরকার মনে করছে শিক্ষার প্রচার-প্রসার বা উন্নয়ন ঘটলে দেশ ও জাতি সমৃদ্ধ হবে- এটা একটা ইতিবাচক দিক। আবার শিক্ষকের আর্থসামাজিক মর্যাদা অন্যান্য পেশার সঙ্গে সমন্বয় করে অনেকাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শিক্ষকের মর্যাদা বা সম্মান বাড়েনি বরং দিন দিন কমেছে। কয়েক দশক আগেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের প্রতি যে শ্রদ্ধা-সম্মান-আনুগত্য বা বিনয়ী ভাব প্রকাশ করত, পাশাপাশি বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান বিতরণের কারিগর শিক্ষকদের ছাত্রছাত্রী প্রদত্ত সম্মান বা মর্যাদার ক্ষেত্রে যেসব বৈষম্য দৃষ্ট হচ্ছে, সে বিষয়ে বাস্তবতার নিরিখে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।

একসময় দেখা যেত, বিদ্যা অর্জনে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসত, তাদের অধিকাংশ শিক্ষিত এবং সচেতন পরিবারের সন্তান এবং শিক্ষক হিসেবে যারা এই মহান পেশায় আসতেন, তারাই এ পেশাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করতেন। কাজেই শিক্ষকের মর্যাদা বা সম্মানের কমতি ছিল না। গত কয়েক দশকে অসচেতন এবং নিরক্ষর ব্যক্তিদের সন্তানরা ব্যাপক হারে শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করেছে, যা দেশের জন্য কল্যাণকর। তবে তাদের অধিকাংশের পারিবারিক শিক্ষা নেই বললেই চলে। ওইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা সার্টিফিকেট অর্জনের পরে কোনো না কোনো উপায়ে শিক্ষা নামক পেশায় যোগ দিচ্ছে। হয়তোবা শুধু জীবিকা অর্জনের জন্য এ পেশার প্রতি তাদের অনেকের আগ্রহ কিন্তু শিক্ষকতা তাদের জীবনের ব্রত নাও হতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের মর্যাদা বা সম্মান বিষয়ে জ্ঞানের অভাব দেখা দিচ্ছে।

সর্বোপরি শিক্ষকদের উপযুক্ত মর্যাদা দিলে শিক্ষা সমৃদ্ধ হবে, শিক্ষা সমৃদ্ধ হলে দেশ ও জাতি সমৃদ্ধ হবে। এতে জাতির মেরুদণ্ড মজবুত হবে। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে কণ্ঠ মেলাই আদর্শ শিক্ষক তুমি শ্রেষ্ঠ সবার, দিল্লির বাদশাহ সে তো কোন ছার!

লেখক : অধ্যক্ষ, ড. ইমদাদুল হক মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ

বাঁশবাড়িয়া, টুঙ্গিপাড়া

গোপালগঞ্জ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close