মাহজাবিন আলমগীর

  ২০ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

রমজানে বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ

একটি দেশের মানুষকে নিরাপদ ও ভালো রাখতে দেশের বাজারব্যবস্থা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখাটা খুবই জরুরি। প্রতি বছরই রমজান সামনে রেখে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যগুলো যেমন- ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজ, ডাল ইত্যাদির দাম ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এর জন্য প্রতি বছর রমজানের আগে থেকেই যথাযথ প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়া দরকার। এখানে সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, সাধারণ জনগণ বা ক্রেতাসাধারণের নির্ধারণ করা দরকার কীভাবে সচেতন হলে দ্রব্যমূল্য কিছুটা সক্ষমতার ভেতর থাকবে।

রমজান কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়াটা আমাদের দেশে একটা স্বাভাবিক বিষয়ে যেন পরিণত হয়েছে। চাল, ডাল, খেজুর, তেল, চিনি ইত্যাদির পাশাপাশি লেবু, শসা, কাঁচা মরিচ, বেগুন, ধনেপাতা এমনকি ফলের বাজারেও দাম চড়া হতে শুরু করে। আমদানিকারক কিংবা বাজারজাতকারী যত বড় ব্যবসায়ী হোক না কেন, যখন পণ্য সরবরাহ কমে যায়, তখন দাম ঊর্ধ্বগতিতে লাফাতে থাকে। কোনো কোনো বাজার থেকে রমজানে কিছু অত্যাবশ্যকীয় পণ্য অনেক সময় উধাও হয়ে যেতেও দেখা যায়।

অনেকেই লেবু, শরবত দিয়ে ইফতার শুরু করেন, রোজা সামনে রেখে লেবুর দামও বেড়ে গেছে যে লেবু ৩০ টাকা হালি ছিল, তা এখন ৪০-৫০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন মুখরোচক ও আকর্ষণীয় তেলে ভাজার জন্য সয়াবিন তেলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সারা দিন রোজা রেখে যখন প্রোটিন বা শর্করা বেশি গ্রহণ করা উচিত, যেখানে তেলে ভাজাপোড়া ইফতার আমরা বেশি গ্রহণ করি, যা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সয়াবিন তেলের দাম সরকার লিটারে ১০ টাকা কমিয়েছে। তার পরও কোথাও কোথাও আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে ১৭৩ টাকা লিটারে। এ দেশে কোনো দ্রব্যমূল্যের দাম যত দ্রুতগতিতে বাড়ে, অনুকূল পরিস্থিতিতে তা কমে খুবই ধীরগতিতে। রমজানের আগে থেকেই খুবই অস্থির হয়ে আছে চিনির বাজার। শরবতসহ নানা ধরনের মিষ্টি পদের আইটেম তৈরিতে চিনির চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ে। গত ৬ মার্চ চিনির দর কেজিপ্রতি আবারও ৩০ টাকা বাড়ানো হলো, এ অবস্থায় সাধারণ ক্রেতারা চিনি কিনতে গিয়ে বাজারে হিমশিম যে খাবেন সেটা খুব স্বাভাবিক।

আমাদের দেশে খেজুরের সারা বছর যত চাহিদা থাকে, তার প্রায় অর্ধেক থাকে রমজানে। এ বছর রমজান উপলক্ষে বিপুল পরিমাণ খেজুর আমদানি হওয়ার পরও আমদানি মূল্যের দুই থেকে তিন গুণ বেশি দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। খেজুর নিয়ে সব থেকে বেশি কারসাজি যেন খুচরা বাজারে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অতি মুনাফার কারণে এই পণ্যটির মূল্য আকাশচুম্বী।

খেজুর ছাড়াও অন্য ফলের দামও বাজারে ব্যাপক চড়া। বিদেশি ফলের বাজারে অস্থিরতা। আমাদের দেশি ফলের বাজারেও যেন উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যেমন রমজান মাসে তরমুজের ব্যাপক চাহিদা থাকে রোজাদারদের ভেতর। গত রমজানে এ ফলটি কেজিতে রেকর্ড পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছিল। রমজানে আর একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য পেঁয়াজ, ভারত থেকে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ পাঠানোর কথা রয়েছে, তবে পেঁয়াজের বাজারে এর প্রভাব কতটুকু পড়বে তা এখনো বলা যাচ্ছে না।

গরুর মাংসের বাজারো অনেক দিন ধরেই অস্থির, সর্বশেষ শবেবরাত উপলক্ষে গরুর মাংস কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে কোথাও কোথাও ৮০০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে। রমজানে গরুর মাংসের ব্যাপক চাহিদা থাকে, এ উপলক্ষে মাংস ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট দাম বাড়ানোর সুযোগ নেন, রমজানে আর কমবে বলে মনে হয় না। বাজারে নতুন আলুর ব্যাপক সরবরাহ থাকলেও দাম কেজিতে ৪০ থেকে ৩৫ টাকার কম পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও অন্যান্য দ্রব্য থেকে কিছুটা স্বস্তি হয়তো আলুর বাজারে। রমজানে ডিম খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়, ডিমের চাহিদা কমে যাওয়ায় দামও তুলনামূলক কম থাকে।

আসলে রমজান মাসে ক্রেতার অতিরিক্ত চাহিদার কারণেই ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যে এত অধিক মুনাফা লোটার সুযোগ পান। আমরা ক্রেতারাই যেন সে সুযোগ তৈরি করে দিই। যেমন আমরা যদি ইফতার আইটেম হিসেবে হালিম, তেহারি, বিরিয়ানি, কাবাবসহ নানা লোভনীয় ইফতার আইটেমগুলো খাওয়া কমিয়ে দিতাম, তাহলে হয়তো গরুর মাংসের চাহিদা কমে যেত। কোনো খাদ্যপণ্যের প্রতি যদি ক্রেতাদের আগ্রহ কম থাকে, তবে তার চাহিদা কমে যায়। আর চাহিদা কমলে, দ্রব্যমূল্যও কমে যায়।

এজন্য সব থেকে আগে যেটা দরকার তা হলো সর্বক্ষেত্রে ভোগবিলাসিতা কমিয়ে রমজান মাসে সত্যিকার অর্থেই সংযমী হওয়া। এই সংযমের মাসে সংযমী তো আমরা হই না, বরং সর্বক্ষেত্রে যেন ভোগসর্বস্বতা বেড়ে যায়। অনেকেই আছে সারা দিন না খেয়ে এক বেলায় তিন বেলার আহার খাবেন। প্রতিটি পরিবারেই ইফতারে বেগুনি, পেঁয়াজু, ছোলা, হালিম, দইবড়া, জিলাপি, কাবাবসহ নানা পদের বাহারি ইফতারির সমাগম ঘটে। এসবের এত ক্রেতা আছে বলেই দেদার বিক্রি হয়। অথচ সারা দেশে এমন অনেক নিম্নবিত্ত বা হতদরিদ্র পরিবার আছে, যারা সামর্থ্যরে অভাবে শুধু ছোলামুড়ি আর শরবতসহকারে ইফতার-পর্ব সেরে নেয়। এসব নিম্নবিত্ত পরিবারের জীবনযাপন প্রণালি নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা থাকলে ভোগবিলাসিতা আমাদের তেমন স্পর্শ করতে পারত না। ইফতারি বাজারের ফর্দ কাটছাঁট করে আমরা তখন সমাজের অন্যদের কথাও ভাবতাম। জীবনযাপনের কৃচ্ছ্রসাধন তখন রমজানের উদ্দেশ্য হয়ে উঠত।

আমাদের দেশে বাজার ব্যবস্থাপনার গতি-প্রকৃতি এমনিতেই দুর্বল। রমজান মাসে তা যেন আরো নাজুক হয়ে ওঠে। দ্রব্যমূল্য হয়ে ওঠে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আর সিন্ডিকেটের ইচ্ছাধীন। পাশাপাশি সরকারি চরম অব্যবস্থাপনার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পাশাপাশি সাধারণ ক্রেতাদেরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। রমজান মাসে আমরা যেন ঋণ করে হলেও খেতে ভালোবাসি। সত্যিকার অর্থেই সংযমী হলে যৎসামান্য ইফতারি আর ডাল-ভাত দিয়েই সাহরি পর্ব শেষ করতে পারতাম। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে রমজানে আমাদের ভোগবিলাসিতা যেন তত বাড়ছে। এই ঢাকা শহরে এমন অনেক পরিবার আছে যারা সারা বছর যা খরচ না করে, রমজানের এক মাসে ইফতারসামগ্রী ক্রয়ে তা শেষ করে, আবার কিছু পরিবার আছে সাহরি করতেও বড় বড় রেস্টুরেন্টে যায়, দামি রেস্টুরেন্টে সাহরি খাওয়াটা ঢাকা শহরে এখন হাল ফ্যাশনে পরিণত।

রমজানে দ্রব্যমূল্য যেন কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে সে জন্য সরকারকে শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য না দিয়ে সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক হতে হবে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে কাজ করতে হবে, যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে পণ্যমূল্য বাড়ানোর সুযোগ না পায়। এ ক্ষেত্রে টিসিবির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যগুলো আরো বেশি পরিমাণে বিক্রয়ের সুযোগ করে দিত, দরিদ্র জনসাধারণের অনেক উপকার হতো।

ভোগবাদ দিন দিন সমাজে এতটাই বেড়ে যাচ্ছে যে রমজানে আর সংযম বলতে কিছুই থাকছে না। বরং কিছু ধর্মীয় আচারসর্বস্বতায় পরিণত হচ্ছে। সমষ্টিগত চিন্তাচেতনার কোনো অবকাশই থাকছে না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ভোগবাদ মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে ঢুকে পড়েছে, মানুষ পুরোপুরি আত্মকেন্দ্রিক একটি সত্তায় আটকে যাচ্ছে। যেখানে সমাজে অন্যের কথা ভাবছে না। তাই যদি হতো তাহলে রমজান মাস প্রকৃত অর্থেই আমাদের জীবনে সংযম নিয়ে আসত, আমরা চূড়ান্ত ভোগবিলাসিতায় এভাবে লিপ্ত হতাম না। এজন্য দরকার বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার

পরিবর্তন।

লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close