অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

  ১৯ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

পবিত্র রমজানেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময়

ধূমপান বা তামাকজাতীয় দ্রব্য (জর্দা, গুল, সাদাপাতা, খৈনি ইত্যাদি) স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত। ধূমপান ও তামাক ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই সার্বিক দিক চিন্তা করে তামাক ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেন, তবে কোনটা তাদের জন্য মোক্ষম সময় সেটা খুঁজে পান না। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলা যায়, পবিত্র রমজান মাস ধূমপান, তামাকপাতা, জর্দা ছেড়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময়। একজন মানুষ যখন সারা দিন কোনো কিছু না খেয়ে থাকতে পারে এবং দিনের এই দীর্ঘ প্রায় ১৩ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় না খেয়ে থাকতে পারেন এবং সে সময় সিগারেট, জর্দা, পান কোনো কিছুই না খেয়ে থাকতে পারেন, তারা কেন জীবনের বাকি সময়ের জন্য ধূমপান বা তামাক ছাড়তে পারবেন না? এটা তো সম্পূর্ণভাবে একজন মানুষের ইচ্ছা ও সংকল্পের ওপর নির্ভর করে। তা ছাড়া রমজান হচ্ছে সংযমের মাস। এ সময়ে মানুষ অনেক সংযমী হয় এবং সারা দিন ধর্মীয় নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলার সঙ্গে চলতে হয়। তাই এই রমজান মাস তামাক ও ধূমপানকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিন আপনার জীবন থেকে। এই সিদ্ধান্তের মধ্যেই নিজের এবং অন্যের মঙ্গল অন্তর্নিহিত। কেননা, তামাক বা ধূমপান কোনো খাদ্য নয় যে এটি আপনার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। এটি এক ধরনের ক্ষতিকর নেশা। এই নেশার মূল উপাদান ‘নিকোটিন’।

বহুকাল থেকে মানুষ দুভাবে তামাকের ব্যবহার করে আসছে। একটি হচ্ছে ধোঁয়াহীন তামাক বা জর্দা, গুল, সাদাপাতা, আরেকটি হচ্ছে ধোঁয়াযুক্ত তামাক বা সিগারেট, চুরুট ইত্যাদি। বিজ্ঞানের গবেষণায় এই দুই ধরনের তামাকই দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তামাক এবং বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় ৭০০০-এর বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। যার মধ্যে ৭০টি রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি ক্যানসার সৃষ্টি করে। এর মধ্যে নিকোটিন, কার্বন-মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, বেনজোপাইরিন, ফরমালডিহাইড, অ্যামোনিয়া, পোলোনিয়াম ২১০ উল্লেখযোগ্য।

তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে বছরে ৮৭ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। বাংলাদেশে তামাকের কারণে বছরে প্রাণহানি ঘটে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি (টোব্যাকো অ্যাটলাস-২০১৮)। সুতরাং, করোনা মহামারির চেয়ে বড় মহামারি ‘তামাক’। এক কথায় বলতে গেলে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ ও আমাদের দেহের সব অঙ্গ প্রতঙ্গ তামাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন : মাথার চুল পড়া, চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট, মুখ ও গলার ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ, পাকস্থলীর ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, যৌনশক্তি নাশ, গর্ভপাত, মৃতশিশু জন্ম, পায়ের পচনশীল রোগ, গ্যাংগ্রিন, পা কেটে ফেলা ইত্যাদি। ধূমপান যে শুধু ধূমপায়ীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নয়, বরং পাশে থাকা অধূমপায়ীকে সমানভাবে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে।

তামাক সেবন প্রতিরোধযোগ্য অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যয়বহুল রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। তামাক সেবনের ফলে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার ৬৭ শতাংশ, যার অন্যতম কারণ তামাক সেবন। এর ফলে ফুসফুস, মুখ, খাদ্যনালি, গলা, মূত্রাশয়, কিডনি, লিভার, অগ্ন্যাশয়, কোলন, মলদ্বার এবং মহিলাদের জরায়ুর ক্যানসারসহ মাইলয়েড লিউকেমিয়া এবং আরো বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার হতে পারে। সব মিলিয়ে ২৭ শতাংশ ক্যানসারের ক্ষেত্রে তামাক সেবনকে দায়ী করা হয়। ৯০ শতাংশ ফুসফুস ক্যানসারের ক্ষেত্রেই প্রধান কারণ তামাক ও ধূমপান। অর্থাৎ তামাক সেবন/ধূমপান বর্জন করলে ৯০ শতাংশ ফুসফুস ক্যানসার এড়ানো সম্ভব। বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহার মৃত্যুর প্রতিরোধমূলক একমাত্র কারণ হিসেবে বিবেচিত এবং প্রতি দশজনে একজনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সরাসরি দায়ী।

একজন ধূমপায়ী ব্যক্তি নিজের ক্ষতির পাশাপাশি আশপাশের অন্যদেরও ক্ষতি করে থাকে (পরোক্ষ ধূমপান), যা সম্পূর্ণ অনৈতিক কাজ। যারা ধূমপান করেন বা তামাক সেবন করেন, তাদের মুখে ও শরীরে এক ধরনের উৎকট বিশ্রী দুর্গন্ধ হয়, যা মানুষের কষ্টের কারণ হয়। ধর্মেও এগুলোকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ধূমপান করে অন্যের ক্ষতির কারণ হওয়া বিষয়টি নিয়ে ধূমপায়ীসহ সবাইকে ভাবতে হবে। কারণ, আমাদের দেশে বিরাটসংখ্যক জনগণ তামাকের ভোক্তা। বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি তামাকসেবী জনগণের মধ্যে অন্যতম একটি দেশ।

গ্লোব্যাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস্) ২০১৭-তে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্নভাবে তামাক সেবন করে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশ ধূমপান করেন, যার সংখ্যা ১ কোটি ৯২ লাখ। তাদের কারণে আবার কর্মক্ষেত্রে ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ, গণপরিবহনে প্রায় ৪৪ শতাংশ এবং ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ রেস্তোরাঁয় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। বাড়ি, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র ও জনসমাগমস্থল মিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি! বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬১,০০০ শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১২ লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পরোক্ষ ধূমপান অধূমপায়ীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ। শিশুদের ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিন্ড্রোম’ রোগেরও কারণ পরোক্ষ ধূমপান। মানুষ জেনে-বুঝে যেমন নিজের ক্ষতি করতে পারেন না, তেমনি অন্যের ক্ষতি করাও সম্পূর্ণ অনুচিত। রমজান মাসে একজন মানুষ ধূমপান ও তামাক সেবন বাদ দিয়ে নিজের প্রতি যেমন যত্নবান হচ্ছে, তেমনি অন্যের ক্ষতির কারণ হওয়া থেকেও বিরত থাকছেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইন প্রতিপালনেও ভূমিকা রাখছেন। কারণ, দেশের আইন অনুসারে পাবলিকপ্লেস, পরিবহনে ধূমপান করা দণ্ডনীয় অপরাধ। যত্রতত্র ধূমপান না করে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা প্রকারান্তে দায়িত্ববান ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন সুনাগরিক চরিত্রকে নির্দেশ করে।

সুতরাং এই পবিত্র মাসে যদি সিগারেট বা জর্দা না খেয়ে কাটাতে পারেন তবে বছরের বাকিটা সময় তামাকবিহীন থাকতে পারবেন না কেন? রোজা রাখার সময় থেকেই একজন ধূমপায়ীকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমি এই পবিত্র রমজান মাসে যেহেতু রোজা রাখব, নামাজ আদায় করব, সংযমী হব সেহেতু, আমি এখন থেকেই আমার এই বদ অভ্যাসটিকে বা নেশাকেও পরিত্যাগ করব। সারা দিন রোজা রেখে ইফতারি করেই ধূমপানের তাড়না দেখা যায় অনেকের মধ্যে, যা রমজানের সংযমকে দুর্বল করে এবং স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো ফল আনে না। ইফতারের পরে ধূমপান স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। তাই রমজানে ধূমপান ত্যাগ করার জন্য দৃঢ়চেতা ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোবল বজায় রাখতে হবে। একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এই ধরনের বদণ্ডঅভ্যাস বা নেশা থেকে মুক্ত হতে পারেন। সুতরাং পবিত্র এই রমজান মাস থেকেই শুরু হোক সব ধরনের তামাক বর্জন। এ ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নেওয়া যেতে পারে।

আপনি যদি ধূমপান ছাড়তে পারেন তবে আপনার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবরাও বিভিন্নভাবে উপকৃত হবেন। যেমন :

১. তারা মুক্ত বায়ু সেবনের আস্বাদ পাবেন।

২. আপনি তাদের সঙ্গে মিশে আরো আকর্ষণীয় ও মধুর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবেন। কারণ একটি বিদেশি প্রবাদ আছে- একজন অধূমপায়ীকে চুমু দাও এবং তার স্বাদ অনুভব করো, দেখবে কত সুখকর সেই মুহূর্তটি।

৩. আপনি যদি ধূমপান না করেন তবে আপনার সন্তানও ধূমপান করবে না, কারণ শিশুরা যা দেখে তা-ই শেখে।

৪. যারা ধূমপান করেন, তাদেরই শুধু বিপদের সম্ভাবনা থাকে তা-ই নয়, তাদের আশপাশে যারা থাকেন তাদেরও বক্ষব্যাধি ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ধূমপান ছাড়তে প্রবল ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন। কাজটি কয়েকটি পর্যায়ে করা যায়।

১. প্রথমত. আপনি চিন্তা করে নিন কেন ধূমপান ছাড়বেন। মনে মনে শক্ত যুক্তি খুঁজে নিতে চেষ্টা করুন।

২. আপনি নিজের মনকে ওই যুক্তিগুলোর আলোকে ধূমপান ছাড়ার জন্য প্রস্তুত করতে থাকুন।

৩. সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপনি বিশেষ দিনে কাজটি সম্পন্ন করুন। সেদিন অবশ্যই ধূমপান ছেড়ে দিন।

৪. আপনার ধূমপানের নেশার তাগিদ উঠলে অন্য কোনো কাজে বা চিন্তায় নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।

৫. রমজানে ইফতারির পর ধূমপানের ইচ্ছা প্রবল হয়। এ সময় চিন্তাশীল ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকুন।

৬. রমজানের সংযম অন্য দিনগুলোতেও কাজে লাগান। যেমন : রোজা রাখাকালীন সময়ে যেমন খাদ্য বা কোনো পানীয় গ্রহণ না করে সংযম বজায় রেখেছেন, নিজের ও প্রিয়জনদের স্বার্থে সিগারেট সেবনের ক্ষেত্রেও সংযম বা সংকল্প ধরে রাখুন। দেখবেন আপনি জয়ী হবেন। আর জয়ী হতে পারলেই রক্ষা পেতে পারবেন তামাকজনিত অসংখ্য রোগের ঝুঁকি থেকে। তাই আর দেরি কেন? রমজান হোক তামাকের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথ। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও ধর্মের প্রতি অগাধ সম্মান ধূমপানের মতো ক্ষতিকর নেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক

সম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি বারডেম ও অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close