মোহাম্মদ ইউসুফ

  ০৯ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

শিক্ষাব্যবস্থার নানামুখী সমস্যা ও প্রতিকার

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষিত জাতি বা জনগোষ্ঠী সুসম উন্নয়নের পূর্বশর্ত। শিক্ষা মানুষকে সচেতন করে তোলে। নিরক্ষরতা মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে আবদ্ধ রাখে। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে হতে হয় যথাযথ, সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী। শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বাহন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান অনেক সমস্যার কারণে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা সম্প্রসারণশীল কিন্তু গুণগতমান সন্তোষজনক নয়। গত তিন দশকে শিক্ষায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নে বড় ঘাটতি থাকছে, আছে সমন্বয়হীনতা। শিক্ষার নানা পর্যায়ে অনেক পরিবর্তন এলেও মান কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষা বহুধাবিভক্ত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য। গ্রাম-শহরের শিক্ষায় দৃষ্টিকটু বৈষম্য, বৈষম্য ধনী-দরিদ্রের শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের মোট শিক্ষার্থীর ৭২ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে লেখাপড়া করে। বাকি ২৮ শতাংশ লেখাপড়া করে শহরাঞ্চলে।

শিক্ষার সুযোগ শহরের তুলনায় গ্রামে অনেকাংশেই কম। গ্রামে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ থাকলেও নামিদামি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শহরাঞ্চলেই অবস্থিত। যার কারণে দরিদ্র জনগণের ক্ষেত্রে যথাযথ শিক্ষালাভ নিশ্চিত হয় না এবং গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ উচ্চতর শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। গ্রামের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অবকাঠামোগত দিক থেকে সমৃদ্ধ না। বিশেষত গ্রামের স্কুল, কলেজগুলো জরাজীর্ণ হয়ে বছরের পর বছর কোনো ধরনের টিকে থাকে। এগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে কারো দৃষ্টিপাত হয় না। তা ছাড়া দেশের সুষ্ঠু শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে না পারার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মানব্যবস্থাকে তলানিতে নিয়ে গেছে। উচ্চশিক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনকারীদের মধ্যে ২ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ বেকার।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আরেকটি বড় সমস্যা হলো কারিগরি শিক্ষার অপর্যাপ্ততা। আমাদের দেশের পাঠ্যসূচিকে এমনভাবে গঠন করা হয়েছে গৎবাঁধা মুখস্থ না করলে কোনোভাবেই ভালো ফলাফল করা সম্ভব নয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ফলে প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষায় হাতে-কলমে জ্ঞান অর্জন হয় না। কারিগরি শিক্ষার অভাবে শিক্ষার সঙ্গে বাস্তবতার অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। তা ছাড়া শহরের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্ধিত ছাত্রছাত্রী সমস্যার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত স্থান ও শিক্ষা উপকরণ সংস্থান করতে পারে না। ফলে শিক্ষার মানও দিন দিন খারাপ হতে থাকে।

উচ্চশিক্ষার যেসব সমস্যাবলি রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সেশনজট। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট থাকলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অধিভুক্ত কলেজগুলোতে সেশনজট সমস্যাটি প্রকটভাবে দেখা যায়। এর কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের মূল্যবান সময়গুলো হারিয়ে ফেলে। কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়া হয় দুঃসাধ্য। এরূপ অবস্থায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয় এবং তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। শিক্ষায় অব্যবস্থার ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। শিক্ষাব্যবস্থায় আরেকটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষকসংকট ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব। সংসদে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের দেওয়া তথ্য মতে, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৩৭ হাজার ৯২৬টি শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষক পদেই রয়েছে ২৯ হাজার ৮৫৫টি। ‘এনটিআরসিএ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক শূন্য পদের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। তা ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ করা হয় ১ লাখ ৪ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ ছিল ৯৯ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সে হিসেবে বাজেট কমেছে ১ শতাংশ।

শিক্ষায় বহুমাত্রিক সংকট ও অব্যবস্থাপনা নিরসনে সরকারের উচিত জাতীয় বাজেটের একটি উচ্চ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ করে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে আরো বেশি স্কুল নির্মাণ, সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং উন্নত অবকাঠামো ও সম্পদের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়নে এই বর্ধিত বিনিয়োগ পরিচালিত হওয়া উচিত। পুঁথিগত বিদ্যার পরিবর্তে এখন কর্মমুখী তথা প্রযুক্তিনির্ভর কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া এবং শিক্ষকসংকট নিরসনে শূন্য পদ পূরণ করা, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোসহ উচ্চশিক্ষায় সেশনজট ও শিক্ষকসমাজে বিভাজন কমাতে হবে। আর্থিক অসাম্য যেন শিক্ষাবণ্টনে প্রভাব না ফেলে, সরকারকেই তা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close