reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৬ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

মাধ্যমিক শিক্ষায় বদলি প্রসঙ্গ

রেজাউল ইসলাম

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সুষ্ঠু বদলি প্রক্রিয়া একটি প্রথাসিদ্ধ বিষয়। বাংলাদেশও এ বিষয়ে ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বদলির রেওয়াজ প্রচলিত আছে। আলাদা আলাদা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তরের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা বদলি নীতিমালা, যার ভিত্তিতে বদলি কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক। এ অধিদপ্তরের আওতাধীন উচ্চশিক্ষা স্তরের সরকারি কলেজ সেকশনের জন্য একটি সুষ্ঠু বদলি নীতিমালা থাকলেও মাধ্যমিক সেকশনের জন্য মানা হয় না সে রকম নীতিমালা, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার ওপরে।

একটি দেশের প্রশাসনকে গতিশীল, কার্যকর, জবাবদিহিমূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত করে গড়ে তুলতে সে দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মস্থল থেকে বদলির ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসনও তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর এক কর্মস্থল থেকে অন্য কর্মস্থলে বদলি করে থাকে। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনীসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই এমন বদলি কার্যক্রম চলে এবং সরকার বিভিন্ন শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের বদলির ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানদের কাছে অর্পণ করেছে। তবে, নির্দিষ্ট কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার জনস্বার্থে এরূপ বদলির ক্ষমতা সংরক্ষণ করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, থানা নির্বাহী অফিসারদের এক কর্মস্থল থেকে অন্য কর্মস্থলে বদলির ক্ষমতা সরকার নিজেই সংরক্ষণ করতে পারে।

বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বদলি নীতিমালায় বলা আছে, একই পদে ৩ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার অব্যবহিত আগেই মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও এদের অধীনস্থ দপ্তর/পরিদপ্তরসমূহের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নতুন পদে বা স্থানে বদলি করতে হবে। কর্মকর্তা ও কর্মচারী সবার ক্ষেত্রে উক্ত আদেশ প্রযোজ্য হবে যদি বর্তমানে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী পদটি বদলিযোগ্য হয়ে থাকে। এই নীতিমালায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আরো বলা আছে, সরকারি ও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা/দপ্তর/পরিদপ্তর এবং অন্যান্য বদলিযোগ্য কর্মকর্তা যাহারা একই স্থানে বা একই পদে তিন বছরের অধিককাল যাবৎ কর্মরত আছেন তাদের অবিলম্বে বদলি করতে হবে। বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন বছর পরপর বদলির এই রেওয়াজ এমনকি চাকরিজীবী দম্পতিদের জন্যও একই। সরকারি চাকরিজীবী স্বামী-স্ত্রীদের জন্য বদলি নীতিমালায় বলা আছে, যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী এবং তাদের স্ত্রীরা উভয়ে একই স্থানে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত আছেন তাদেরও একই পদে ৩ বছরের অধিককাল চাকরি হলে বদলি করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে নতুন বদলির স্থানে উভয়ের উপযোগী পদ থাকতে হবে এবং উভয়কে একসঙ্গে বদলি করতে হবে।

শুধু শিক্ষা খাত বাদে বাংলাদেশের প্রায় সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরে ওপরে উল্লিখিত বদলি নীতিমালা কমবেশি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ব্যতিক্রমও থাকতে পারে। সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। তবে শিক্ষা খাত এ ব্যাপারে সবচেয়ে অবহেলিত। বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সরকারি কলেজ পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বদলি নীতিমালা স্বল্প পরিসরে কার্যকর থাকলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরিরতদের জন্য, বিশেষ করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বদলির তেমন সুষ্ঠু কার্যক্রম নেই। বিক্ষিপ্ত পরিসরে আবেদনের ভিত্তিতে এবং জনস্বার্থে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষকের বদলির আদেশের উদাহরণ পাওয়া গেলেও এখানে বদলির সুষ্ঠু কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের যেখানে তিন বছর পরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বদলির আদেশ হওয়ার কথা, সেখানে একজন শিক্ষকের একই বিদ্যালয়ে একাধারে বিশ থেকে পঁচিশ বছর কিংবা তারও বেশি সময় পর্যন্ত চাকরি করার উদাহরণ আছে।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বিক্ষিপ্তভাবে কিছুটা বদলির সুযোগ থাকলেও এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বদলির কোনো সুযোগ নেই। এটার কারণ হলো পুরোপুরি সরকারি প্রতিষ্ঠান না হওয়ার কারণে এখানে কোনো বদলি নীতিমালা নেই। ২০২৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০,৩১৬টি। এদের মধ্যে মাত্র ৩৩৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ) সুষ্ঠু বদলি প্রক্রিয়া কার্যকর আছে- এমনটি ধরে নিলেও বাংলাদেশের বাকি ৯৮ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো বদলি নীতিমালাই এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি।

তবে আশার বিষয় হলো, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য বদলির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আলোচিত হচ্ছে। এই আলোচনার মূল কারণ হচ্ছে ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক সুপারিশকৃত শিক্ষকদের বেশির ভাগেরই পদায়ন হচ্ছে তাদের নিজ নিজ জেলা থেকে শত শত কিলোমিটার দূরের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নিজের পরিবার থেকে এমন দূরের কোনো জায়গায় পুরো চাকরিকাল অতিবাহিত করার বিষয়টি অনেকের শরীর ও মনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তা ছাড়া, এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য বর্তমানে যে বেতন-ভাতার সুযোগ আছে, তা দিয়ে বর্তমান বাজারে দু-তিনজন মানুষের সংসার চালানোই কষ্টসাধ্য। সেখানে শত শত কিলোমিটার দূরের রাস্তা ধরে নিজ জেলায় পরিবারের সঙ্গে মাসে দু-একবার দেখা করতে আসার জন্য গাড়ি ভাড়া জুটবে কীভাবে?

এই কারণগুলো যদিও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলির পেছনের উপযুক্ত ও কার্যকর কারণ নয়, তবুও এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বদলির এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কারণ এ সমস্যাগুলো ধরে একবার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য বদলির রেওয়াজ চালু হয়ে গেলে তা আস্তে আস্তে একটি সুষ্ঠু বদলি নীতিমালায় পরিণত হবে এবং এর মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের বদলি কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হবে।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য বদলির নীতিমালা না থাকায় এখানকার প্রায় পঁচানব্বই ভাগ শিক্ষককেই চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে অবসরে যেতে হয়। এতে এ দেশের শিক্ষা খাতে বিরাট ক্ষতি ঘঠে, যা আমরা হয়তো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করি না।

অন্যান্য অফিস-আদালতের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন চাকরি করলে তিনিও দুর্নীতিতে জড়িয়ে যেতে পারেন। তিনি ওই বিদ্যালয়ের কোচিংবাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে পারেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয়ভীতি দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের কোচিংয়ে টানতে পারেন। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা কমিটি ও রুটিন কমিটিতে থেকে অবৈধ প্রভাব খাটাতে পারেন। বোর্ড পরীক্ষার কমিটিতে দীর্ঘদিন থাকার ফলে পছন্দের শিক্ষার্থীর জন্য টাকার বিনিময়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারেন। সিন্ডিকেট গড়ে তুলে বিদ্যালয়ের সরকারি-বেসরকারি ফান্ডের যথেচ্ছা ব্যবহার করতে পারেন ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো, এগুলো এখন আর কোনো অনুমিত বিষয় নয়, বরং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব আজকাল অহরহ ঘটছে এবং দেশের পত্রপত্রিকায় সেসব ছাপাও হচ্ছে।

একটি সুষ্ঠু বদলি নীতিমালাই পারে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে। অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরে মতো শিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রতি তিন বছর পরপর বদলির বিধান চালু করলে সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতি ও অনিয়মকে প্রতিহত করতে পারবে। রাতারাতি সব হয়তো সম্ভব হবে না। তবে বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সরকারি কলেজপর্যায়ে বদলির যে সহজ কার্যক্রম চালু হয়েছে, তা যদি বাংলাদেশের সব মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু করা যায়, তবে সেটি হবে বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য একটি বৈপ্লবিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা হলো একটি দেশের শিক্ষা খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এখান থেকেই উচ্চশিক্ষার সিঁড়িতে ওঠে দেশের ভবিষ্যতের কাণ্ডারীরা। এই স্তরে একটুখানি হেলাফেলা তাই ডেকে আনতে পারে শিক্ষা খাতের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। শিক্ষকদের বদলির সুযোগ এখানে প্রণোদনার মতো কাজ করতে পারে। এতে একদিকে তাদের দীর্ঘদিন ধরে এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার একঘেয়েমি দূর হবে। অন্যদিকে, তাদের নিয়মিত বদলির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত। এ দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষকের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন হচ্ছে একটি সুষ্ঠু বদলি নীতিমালার অংশীদার হওয়া। কিন্তু, সবার মুখে একই প্রশ্ন, কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ?

লেখক : সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)

পাইকগাছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, খুলনা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close