মুফতি মোহাম্মদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ধর্মকথা

কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বাড়ানো কবিরা গুনাহ

আমরা আল্লাহর বান্দা। ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবতা ধর্মের ভূষণ। আমাদের যাপিত জীবনে হালাল পথে থাকা হারামকে বর্জন করা সবার ইমানি দাবি। হালাল উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা শ্রেষ্ঠতম ইবাদত। রজব মাস শেষের দিকে। পবিত্র হাদিস শরিফ থেকে জানা যায়, রাসুল (সা.) রজব মাস থেকেই মাহে রমজানের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতেন। আর পুরো শাবান মাস নফল রোজা রেখে দেহ-মনকে প্রস্তুত করতেন প্রেমময় মাস রমজানের জন্য। নবীজির সাহাবিরাও রমজান মাস উপলক্ষে আত্মাকে সতেজ করতেন পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নফল ইবাদত আর দান-সদকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে।

রাসুল (সা.)-এর জীবন এবং আমাদের রমজান প্রস্তুতি সম্পূর্ণ উল্টো। ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে প্রশিক্ষণের মাস রমজানে ভ্রাতৃঘাতী ও নির্মমতার চর্চাই বেশি হয় আমাদের দেশে। মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবসামগ্রী গুদামজাত করা হয় বেশি মুনাফার লোভে। শাবান মাস জুড়ে চলে এ প্রতিযোগিতা।

মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কম দামে ক্রয় করে, বেশি দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে জমা করে রাখার নাম হলো ‘মজুদদারি’। এ শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ ‘ইহতিকার’। মজুদদারি ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ, কবিরা গুনাহ।

পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা রোজাদারদের গলায় ছুরি ধরে বেশি লাভের আশায় ৬ মাস ১ বছর আগে থেকেই প্রস্তুতি নিই। অথচ অনেক অমুসলিম দেশেও রোজার মাসে রোজাদারদের জন্য বিশেষ সেবা দেওয়ার কথা শুনি থাকি। যেসব ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তাদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা, বেশি মুনাফার লোভে দ্রব্যসামগ্রী গুদামজাত করা স্পষ্টত হারাম। মানুষকে কষ্ট দিয়ে খাদ্যদ্রব্য গুদামজাতের ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস শরিফ থেকে কিছু হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো।

হজরত মা’মার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে সে বড় অপরাধী গণ্য হবে। আর জেনে রাখ! সে গোনাহগার সাব্যস্ত হবে। (মুসলিম ও তিরমিজি) প্রিয় নবীজি (সা.) আরো বলেন, ‘মুজরিম তথা অপরাধীর পক্ষেই সম্ভব পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা।’ (মুসলিম) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসরা বলেন, আলোচ্য হাদিসে মজুদদারকে অপরাধী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘অপরাধী’ শব্দটি সহজ কোনো শব্দ নয়। মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে অপরাধী শব্দটি ফেরাউন, হামান ও কারুনের মতো প্রতাপশালী এবং অহংকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। যেমন : পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই ফেরাউন, হামান ও তাদের সৈন্যবাহিনী অপরাধী ছিল।’ (সুরা কাসাস : ৮) মজুদদারের নোংরা মানসিকতা ও কদর্যপূর্ণ স্বার্থপরতাকে মহানবী (সা.) এভাবে ব্যক্ত করেছেন। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘গুদামজাতকারী কতই না ঘৃণিত মানুষ। আল্লাহতায়ালা দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দিলে সে চিন্তায় পড়ে যায়। আর বাড়িয়ে দিলে সে আনন্দিত হয়। (শুআবুল ইমান ও মিশকাত) হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখবে, মানুষকে কষ্ট দেবে, সে এ সম্পদ দান করে দিলেও তার গোনাহ মাফের জন্য যথেষ্ট হবে না। (মিশকাত)

খাদ্যদ্রব্য গুদামজাতকারী সম্পর্কে রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমদানি করবে সে রিজিকপ্রাপ্ত হবে। আর যে গুদামজাত করবে সে অভিশপ্ত হবে।’ (ইবনে মাজাহও সুনানে দারেমি)

যে ব্যবসায়ীরা মজুদদারির আশ্রয় নেয়, তাদের অন্তর থেকে আল্লাহভীতি দূর হয়ে যায়। বাজারে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করার ক্ষেত্রে তাদের মনের মধ্যে পঙ্কিলতার সৃষ্টি হয়। তারা মানবিকতার বিরুদ্ধে কাজ করে। পরে যদি তারা দান-সদকার মাধ্যমে চেষ্টা করে পুণ্য হাসিলের জন্য। কিন্তু এই দুর্নীতি, অন্যায় ও অত্যাচারের পর, এই দান-সদকা কখনোই তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে আল্লাহর কাছে উপস্থাপিত হবে না। আল্লাহতায়ালা তাকে অবশ্যই মজুদদারির কঠিন শাস্তি দেবেন।

শুধু তাই নয়, মজুদদারির সহায়তা যারা করে তাদের জন্যও কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। (মুসনাদ আহমদ, হাদিস নম্বর : ১৯৪২৬)

রজব মাস শেষের দিকে। শাবান মাস আসছে আসন্ন পবিত্র মাহে রমজানে ব্যবসায়ী ভাইরা মজুদদারি থেকে নিজে বেঁচে থাকবেন। অন্যকেও এই ভয়াবহ গোনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। রোজাদারদের ঠকানোর চিন্তা, মজুদদারির গোনাহ থেকে আল্লাহতায়ালা আমাদের হিফাজত করুন। হালালভাবে ব্যবসা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা, দুনিয়ার সুখ, আখিরাতের মুক্তিলাভের পাশাপাশি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সিদ্দিকদের সঙ্গে জান্নাতি হওয়ার তাওফিক আল্লাহতায়ালা আমাদের দান করুন। আমিন।

লেখক : আরবি প্রভাষক, আউশপাড়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা

খতিব, মণিপুর বায়তুল আশরাফ (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর-২, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close