তানজিব রহমান

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪

মতামত

সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন

বিবিসির তথ্য মতে, ২০২৪ সালে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর নাম উঠে এসেছে। বাংলাদেশের জনগণ এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করে আবারও সরকার গঠনের সুযোগ দান করেছে। যদিও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দেয় এবং ভোট বর্জনের নামে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। বিশ্বের প্রায় ১২০ কোটি ভোটার এ বছর নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের নেতা নির্বাচন করবেন। প্রতিনিয়ত বিশ্ব নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। সংকট থেকে উত্তরণ, সমস্যা সমাধানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বা নতুন নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশের এবারের জাতীয় নির্বাচন অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে ভিন্ন এ জন্য যে বিরোধীরা ভোট বর্জনের নামে বাসে ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সব চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা সফল হয়নি। নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলে ২৯৯ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২২৩টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, স্বতন্ত্র ৬২টি, ১টি করে আসনে জয় পায় ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, কল্যাণ পার্টি। বিএনপি বড় একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিজেদের নেতৃত্ব ও

রাজনৈতিক কৌশলের অভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় যা শীর্ষ নেতৃত্বের রাজনৈক দূরদর্শিতার বিষয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।

এবারের নির্বাচনের সঙ্গে ২০১৪/২০১৮ নির্বাচনের তুলনা অনেকে করলেও ভোটারদের উপস্থিতি ভোটদান শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে অনেক বেশি লক্ষণীয় ছিল বিশেষ করে তরুণ ও মহিলা ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। যেসব প্রার্থী তরুণ ও মহিলা ভোটারদের বেশি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন, তারা তুলনামূলক ভোট বেশি টানতে পেরেছেন। তাই অনেক আসনে চোখ কপালে ওঠার মতো ফল আমরা লক্ষ করেছি, যেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে অনেক এমপি, মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন, যা এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শ্রীবৃদ্ধি করেছে, যা অতীতের নির্বাচন থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। নির্বাচনের অনেক আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন এবারের নির্বাচন স্বচ্ছ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে, তাই সবাইকে গভীরভাবে জনসম্পৃক্ত হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর এ কথার অর্থই ছিল অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভালো নির্বাচন; যা তিনি করে দেখিয়েছেন।

এটাও দ্বাদ্বশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আরো একটি সৌন্দর্য নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন আয়োজন করেছেন এবং কমিশনের ক্ষমতা বলে অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীকে নির্বাচন কমিশনে ডেকে নিয়মভঙ্গের কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। কোথাও কোথাও নির্বাচন বাতিল করার মতো সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছেন; চট্টগ্রাম-১৬ বাঁশখালী আসনে নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে নির্বাচনের শেষ সময়ে বিকেল ৩.৪৫ মিনিটে তার প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন সচিব জানান, তিনি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হুমকি ও একাধিকবার নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করার ফলে কমিশন এ সিদ্ধন্ত গ্রহণ করে, যা এ নির্বাচনে অনন্য উদাহরণ। ভোটের মাঠেও আছে নতুন কিছু নজির যেমন- হাসানুল হক ইনু, ফজলে হোসেন বাদশাহ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন, মৃণাল কান্তি দাশ, অসীম কুমার উকিল, ধীরেন্দ্র দেব নাথশম্ভু, আব্দুস সোবহান মিয়া গোলাপের মতো আওয়ামী লীগের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা এবারের নির্বাচনে জিতে আসতে পারেননি, যা বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অনন্য সংযোজন বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, অনেক শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রার্থীও জিতে আসতে পারেননি। তাদের সংখ্যা মোটাদাগে অনেক হলেও যে কজন পরাজিত হয়ে বেশ আলোচিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাবেক মন্ত্রী হবিগঞ্জ-৪ আসনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, ঢাকা-১৯ আসনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, যশোর-৫ আসনে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। আরো অনেক শক্তিশালী প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে জাতীয় নির্বাচনে হেরেছেন, যা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ব্যতিক্রম। ভোটদানের হার বিবেচনা করলে নির্বাচন অবাধ-সহিংসতা মুক্ত হওয়ার ফলেই ৪১ দশমিক ৮ ভাগের মতো ভোটার ভোট দিতে পেরেছেন, যা আওয়ামী লীগকে নতুন একটি গ্রহণযোগ্যতা দান করেছে। তবে অন্যান্য দল অংশগ্রহণ করলে হয়তো তার পরিমাণ আরো বাড়তে পারত। ভোটারদের ক্ষমতায়নে বা জনগণের ক্ষমতায়নে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে মাইলফলক হয়ে থাকবে। কারণে সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগণ নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশের স্বাধ গ্রহণ করেছে, যা নিয়ে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয় লাভ এবং ২২২ আসনে নিরঙ্কুশ বিজয় স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করবে। তবে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক নানা চ্যালেঞ্জও এ সরকারের জন্য রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী ইশতেহারেই দ্রব্যমূল্য জনগণের নাগালের মধ্যে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, যা বাস্তবায়ন করা নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে যুদ্ধময় বিশ্ব অর্থনীতির প্রভাব, ডলার সংকট, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানির ধারা অব্যাহত রাখা, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ স্বাভাবিক রাখা ও বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়া, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও শিল্পের প্রসার ঘটানো, রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের প্রণোদনা দিয়ে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, অর্থ পাচার রোধে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সর্বস্তরে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে সর্বমহলের একটা আহ্বান নতুন সরকারের প্রতি লক্ষ করা যায়।

তাই বলা যায়, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নতুন রাজনৈতিক কৌশল ও দূরদর্শিতা যেমন সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে নতুন নতুন শ্রী বৃদ্ধি করেছে, ঠিক তেমনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সরকারের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু সমস্যার ত্বরিত সমাধান এ সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা যায়। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি যে রাজনৈতিক ভুল করেছে, তার জন্য আগামীর রাজনীতি কোন দিকে যায়, তার দিকেও তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close