মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

ভুল চিকিৎসায় কারো মৃত্যু কাম্য নয়

মানুষের জীবন অতি মূল্যবান। সেই মূল্যবান জীবন কারো ভুল বা অবহেলার কারণে চলে যাওয়া কোনো মতে কাম্য নয়। অথচ কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন চিকিৎসকের অবহেলার কারণে দেশে অনেক মানুষের জীবনহানির অভিযোগ রয়েছে। একজন অসুস্থ মানুষ চিকিৎসকের অসহায় অবস্থায় দ্বারস্থ হন। সে সময় যথাসম্ভব উন্নত চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা চালানো একজন চিকিৎসকের পেশাগত এবং মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এর অভাবজনিত কারণে রোগীকে রোগভোগের শিকার হয়ে মৃত্যুর দ্বার পর্যন্ত পৌঁছে যেতে হয়। এভাবে ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে পাঁচ বছরের শিশু আয়ানকে খতনা করার পর তার আর জ্ঞান ফিরে আসেনি। পরে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলে ৭ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়। আয়ানের বাবা ভুল অপারেশনের জন্য ডাক্তার সাইদ সাব্বির আহম্মেদ ও ডা. তাসনুভা মাহজাবিনের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে বাড্ডা থানায় মামলা করেন। মৃত্যু যদিও অনিবার্য সত্য, কিন্তু সে মৃত্যুর পেছনে কারো অবহেলা কাম্য হতে পারে না। করোনাকালে দেশের বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার নানা দিকগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। করোনা সংক্রমণের এই সংকট সময়েও আক্রান্তদের জন্য দ্রুত পরীক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি। অক্সিজেন, ভেন্টিলেশন, আইসিইউর অভাবে করোনা রোগীর দুর্দশা, রোগভোগে মৃত্যুবরণের অসহায় চিত্র প্রত্যক্ষ করা গেছে। প্রথম দিকে করোনার সন্তোষজনক চিকিৎসা বা সময়মতো প্রতিষেধক টিকার অপ্রাপ্যতা মানুষকে চরম ভোগান্তির পথে নিয়ে গেছে। ইত্যাবসরে জীবন চলে গেছে অনেক মানুষের। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের করুণ লড়াই বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে কাঁদাবে অনেক কাল। স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে মাত্র ৩৫ শতাংশ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। বাকি ৬৫ শতাংশের ভরসা বেসরকারি হাসপাতাল অথবা প্রাইভেট ক্লিনিক। চাহিদার তুলনায় সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংকট ও জনবলের অপ্রতুলতার কারণে বাধ্য হয়ে রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে যেতে হচ্ছে। আর সেই সুযোগে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা। এর অনেকগুলোর চিকিৎসাসেবাও তেমন মানসম্মত নয়। শহরের বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালে বা গ্রামের চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা পেতেও রোগীদের হিমসিম খেতে হয়। রোগীর অনুপাতে পর্যাপ্ত বেড নেই। হাসপাতালের বারান্দায়, মেঝেতে রোগীদের পড়ে থাকতে হয়। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর দুঃখজনক ঘটনাও বিরল নয়। এ ক্ষেত্রে অনেক চিকিৎসকের অবহেলারও দায় রয়েছে। তাদের দৃষ্টি রয়েছে অঢেল অর্থবিত্ত উপার্জনের দিকে। তারা সম্পৃক্ত থাকেন প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সঙ্গে। দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে অনেক চিকিৎসক রোগীকে পাঠান প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। রোগীদের প্যাথোলজিক্যাল টেস্টও করাতে হয় বাইরের ক্লিনিক থেকে। বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহের কথা থাকলেও অনেক রোগীই এ থেকে বঞ্চিত হন। কিছুদিন আগে দেশের এক খ্যাতনামা শৈল্যচিকিৎসক অল্প বয়সের রোগীকে নিজ চেম্বারে অপারেশন করতে গিয়ে রক্তের নালি কেটে ফেলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে রোগীর প্রবল রক্তক্ষরণে দিশাহারা হয়ে পড়েন রোগীর স্বজন। এমতাবস্থায় একজন জুনিয়র চিকিৎসক রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তরের পর অপারেশর থিয়েটারে অপারেশন করে রোগীকে সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় পুরো চিকিৎসাব্যবস্থাকে। চিকিৎসা দিতে গিয়ে কিছু ভুল চিকিৎসা হতেই পারে, কিন্তু তা সামলানোর ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে।

রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে অনেক। সেখানে অনেক উন্নত মানের চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে। নিয়োজিত আছেন বহু দক্ষ চিকিৎসক। তবে ওইসব হাসপাতালে চিকিৎসার সেবামান নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। এমনিতে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয় মেটানো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর জটিল রোগ হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাওয়া নিয়ে রয়েছে অনেক বিড়ম্বনা। অনেক ডাক্তারের দেখা পেতে অধীর অপেক্ষা করতে হয়। অনেক চিকিৎসকই টেলিফোনে রোগীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন না। খুব সকালবেলা সশরীরে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে নাম লেখাতে হয়। অনেক চিকিৎসককে আবার নির্দিষ্ট দিনে তা ফোনে কনফার্ম করা ছাড়া চিকিৎসকের দেখা মেলে না। এতসব ঝামেলা মিটিয়ে একজন রোগীকে ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নেওয়া অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। নামিদামি চিকিৎসকের কাছে যেতে কখনো দু-তিন মাস সময় লেগে যায়। একজন জরুরি রোগীর পক্ষে এত দিন অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আর ডাক্তারের ফি নেওয়ার ব্যাপারে কোনো নিয়মকানুন মানা হয় না। একজন অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসক কখনো এক হাজার, কখনো-বা দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত ফি নিয়ে থাকেন। ডাক্তারের এত বেশি দর্শনী মূল্য, রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার উচ্চব্যয়ভার বহন করে গরিব মানুষের চিকিৎসা লাভ সম্ভবপর নয়।

চিকিৎসকের কাছে মানুষ বড্ড অসহায়। জীবনের বড্ড সংকট সময়ে মানুষ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিত্তহীন বা নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালই একমাত্র ভরসা। তারা সেখানে ভিড় করেন, নানা বিড়ম্বনার শিকার হন। সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের আউটডোরে বিনা দর্শনীতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র পেলেও ওষুধ কিনতে হয় বাইরের দোকান থেকে। এখন ওষুধের মূল্য হয়েছে আকাশছোঁয়া। রোগ নির্ণয়ের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেতে হয় বাইরের ল্যাবরেটরির কাছে। তাতেও রয়েছে অঢেল অর্থব্যয়। কখনো অপরিপক্ব বা ভুয়া চিকিৎসকের কবলে পড়ে রোগীকে অকালে প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটে। এসবের ব্যতিক্রম চিকিৎসক যারা রয়েছেন তাদের দিয়ে চলে এসব হাসপাতাল। বাংলাদেশে ওষুধের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণেও আইনকানুনের তেমন বাস্তব প্রয়োগ নেই। অনেক ওষুধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বৈধ লাইসেন্সও নেই। ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধপত্র বিক্রি হতে দেখা যায় বাজারে। উন্নত বিশ্বের মতো হাসপাতালে বা ওষুধের দোকানে নেই কোনো প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট। দেশের চিকিৎসার ওপর ভরসা রাখতে পারেন না বলেই হয়তো বিত্তশীলরা সামান্য অসুস্থতাতেই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেন।

সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু সাফল্যও রয়েছে। আজ দেশে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। হার্ট-সার্জারিতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের মতো কঠিন অপারেশনও সম্ভব করে তুলছেন এ দেশের চিকিৎসকরা। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা রোধে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করে বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সেবার ফি নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ফি নির্ধারণের বিষয়টি অর্ডিনেন্স উল্লেখ রয়েছে, যা সরকার আইনে রূপান্তর করবে। এসবের বাস্তবায়ন হলে স্বাস্থ্যসেবার নামে বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিধিবহির্ভূত যে বাণিজ্য চলছে তা বন্ধ হবে, সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। কমব্যয়ে মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারবেন। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দুর্নীতি দূর করতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। কথায় কথায় অহেতুক ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ধর্মঘট, কর্মবিরতি বন্ধ করতে হবে। চিকিৎসাব্যবস্থায় সমস্যাগুলোকে দ্রুত দূর করে চিকিৎসকদের সেবা দানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সর্বস্তরের চিকিৎসকদের তাদের মেধা ও মনন কাজে লাগিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে শহর ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে। সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সর্বোত্তম চিকিৎসাসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের হতে হবে আন্তরিক। রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ ও সেবার মনোভাব নিয়ে দেশের সব চিকিৎসক এগিয়ে আসতে হবে। একজন চিকিৎসক তৈরি করতে রাষ্ট্রের ব্যয় হয় অঢেল অর্থ। তাই রোগীর প্রতি, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি একজন চিকিৎসকের দায়ভার অনেক। নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ছাড়া কখনো মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা গড়ে উঠতে পারে না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলৗ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close