মাজহার মান্নান

  ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

এলিনার মায়ের আর্তনাদ এবং কিছু বার্তা

আজ আমি স্তব্ধ এক মানুষ। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। গত দুসপ্তাহ আগে এলিনা (আমার খালাতো বোন) ফোন দিল। মাজহার ভাই কেমন আছেন। আমি বললাম, নানা কারণে খুব একটা ভালো নেই। এলিনারও ভীষণ মন খারাপ। সপ্তাহখানেক হলো এলিনার বাবা মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাক করে। বাবার মৃত্যুশোক এখনো কেটে ওঠেনি। নানা ঝামেলায় ছিল এলিনা। এলিনার একটি ছেলেসন্তান হয়েছে বিয়ের দীর্ঘ বছর পর। সম্ভবত ১০ বছর পর। ছেলেটি একটি জটিল রোগে আক্রান্ত। ছেলের ব্যাপারে আমাকে ফোন দিয়েছিল। আমি ভারতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিই। সেই অনুযায়ী ভিসা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমাকে বলল, ভাইয়া মার সঙ্গে (আমার খালা) একবার দেখা করিয়েন। প্রায় ৪০ মিনিট ফোনে কথা হয় এলিনার সঙ্গে। বড় ভাই হিসেবে এলিনা খুব ভরসা করত আমাকে। এলিনা বাড়ি (রাজবাড়ী) গিয়েছিল খালুর মৃত্যু-পরবর্তী কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য। ছেলের ভিসা নেবে তাই ঢাকায় ফিরছিল। এলিনা তার ফুপাতো বোন রত্না ও স্বামী বিপ্লব (ইকবাল খান)-সহ রাজবাড়ী থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠেছিল। রত্না আর এলিনা একই ক্লাসে পড়ত। একই বাড়িতে এলিনার মার কাছে থাকত। বিপ্লব রত্নাকে বিয়ে করেছিল। বিপ্লব আমার সঙ্গে পড়ত। দারুণ বন্ধন আছে ওদের সঙ্গে আমার। কিন্তু কে জানত এমন ভয়ানক দিন অপেক্ষা করছে তার জন্য। কে বা কারা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওরা যে বগিতে ছিল সেই বগিতে। রত্না তার বাচ্চাকে বিপ্লবের কাছে দেয়। বিপ্লব জানালা দিয়ে লাফ দেয়। কিন্তু আগুনে বিপ্লবের শ্বাসনালি পুড়ে যায়। সে এখন বার্ন ইউনিটে ভর্তি। এলিনা রত্নার কাছে তার ছেলেকে দিয়েছিল। রত্না দৌড়ে দরজা দিয়ে বের হয় কিন্তু তারও শ্বাসনালি পুড়ে যায়। সেও বার্ন ইউনিটে ভর্তি এখন। কিন্তু এলিনা আর বের হতে পারেনি। এলিনা ফোনে বলেছিল, সে আর বের হতে পারছে না। আগুনে শেষ হলো এলিনার সব স্বপ্ন ও দেহ।

কী বলব। ভাষা তো আমার ভাণ্ডারে নেই। যারা আগুন দিল তারা কী পেল? তাদের সঙ্গে কি এলিনার শত্রুতা ছিল? মোটেও না। কেন এলিনাকে এভাবে জীবন দিতে হলো। কোন রাজনীতির শিকার হলো সে? কোথায় আমরা তবে নিরাপদ? সত্যি কি ভালো আছি আমরা? আর কত এলিনার জীবন দিতে হবে? কবে বদলাবে এই নোংরা সংস্কৃতি? কোনো রাজনীতি না করেও কেন রাজনীতির বলি হলো এলিনা। আমার জানা মতে, রাজনীতি নিয়ে এলিনার কোনো আগ্রহ ছিল না। স্বামী-সংসার নিয়েই তার যত ভাবনা। তবু কেন তাকে অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হতে হলো। কতটুকু রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণ পাবে এলিনা ও তার পরিবার? যে দুধের শিশু রেখে এলিনাকে চলে যেত হলো, তার দায়ভার কে নেবে? শিশুটি বড় হয়ে কী জানবে? দেশের প্রতি তার কতটুকু শ্রদ্ধাবোধ জন্মাবে? এলিনার স্বামী কীভাবে সামলাবে সবকিছু? খালাকে দেখেছি কত কষ্ট করে এলিনাকে বড় করতে। এলিনা খালার বড় সন্তান। কী করে খালা সইবে এই কষ্ট। কোনো দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে সেটা মেনে নেওয়া হয়তো সহজ হতো। কিন্তু এই অগ্নিসন্ত্রাসীদের কি কোনো বিবেক নেই। তারা কী অর্জন করতে চায়? মানুষ পুড়িয়ে কারা স্বার্থ হাসিল করতে চায়? যে মানুষটি পুড়ছে তার কী অপরাধ? অন্যের স্বার্থের বলি হতে হবে তবে এলিনাদের? নির্বাচন এলেই অগ্নিসন্ত্রাস শুরু হয়। কিন্তু কেন? নির্বাচন তো একটি আনন্দের বিষয়। নির্বাচনের দিন ঈদ উৎসবের মতো থাকে। নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে চায়ের কাপে ঝড় চলে অলিগলিতে। নির্বাচন হয়ে গেল। এমপি ও মন্ত্রীরা শপথ নিলেন। নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার শপথ তারা নিলেন। কিন্তু আমরা কি নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারলাম?

নির্বাচন হয়ে গেল। সরকার গঠিত হলো। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট তো থেকেই গেল। আর রাজনৈতিক সংকট যেখানে প্রকট, সেখানে সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টিও ঝুঁকিতে থাকে। এলিনার পরিবার কি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাবে? তার পরিবার কি ভুলতে পারবে এই নির্মমতা? দেশের রাজনৈতিক সংকট অনেক গভীরে চলে গেছে। এটা থেকে আমাদের মুক্তি প্রয়োজন। নির্বাচন হয়ে যাওয়াই সব সমাধান নয়। একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি বড় প্রয়োজন। এলিনা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেল আমাদের আসলে নিরাপত্তা কতটুকু? রাজনীতি এবং নাগরিক নিরাপত্তা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সুস্থ রাজনীতি নাগরিক নিরাপত্তার প্রধান পরিমাপক। রুগ্ণ রাজনীতি পরতে পরতে নাগরিক জীবনে সংকট তৈরি করতে পারে। এলিনার পরিবারের কষ্টটা কত গভীরে তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তার ভস্মীভূত দগ্ধ লাশ শনাক্ত করাও সম্ভব হয়নি। এলিনার সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের পক্ষেও এলিনাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়ে শুধু যে এলিনার জীবন গেছে তা নয়। অনেকের জীবনহানি ঘটেছে এই অগ্নিসন্ত্রাসে। অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। আগুনের লেলিহান শিখা কত মানুষের স্বপ্নকে ছাই করে দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আজ দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় কি যোগাযোগ নিরাপত্তা বেড়েছে? বাস্তবতা দেখে সেটা মনে হয় না। এলিনার জন্য হয়তো দুফোঁটা চোখের জল ফেলার লোক আছে। কিন্তু এলিনা যে নিষ্ঠুর বাস্তবতার বলি হলো সেটার দায় নেওয়ার কি লোক আছে? সেটা নিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছা কতটুকু আছে আমাদের?

এলিনাকে পুড়তে হয়েছে কারো না কারো নোংরা ও বিকৃত স্বার্থের কারণে। এ স্বার্থ কোনো ব্যক্তিগত নয়। কারণ এলিনার সঙ্গে কারো কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। সে একটি ঘাতক পরিবেশের বলি মাত্র। রাজনৈতিক স্বার্থ যখন মনুষ্যত্বকে হার মানায়, তখন কোন এলিনা মরল, কোন এলিনা বাঁচল তাতে কী যায় আসে। একজন এলিনার মৃত্যু হয় তো তাৎক্ষণিকভাবে দেশের জনগণকে নাড়া দেবে। কয়েক দিন সংবাদ পরিবেশিত হবে। তারপর জনগণ সেটা ভুলে যাবে। কিন্তু যে নির্মমতার শিকার সে হলো সেই নির্মমতার ইতিহাস কি ঘেঁটে দেখা হবে? সেটা থেকে কি পরিত্রাণের চেষ্টা করা হবে? বিষাক্ত রাজনীতির ছোবল কি সত্যি বন্ধ হবে? মানুষের মাঝে মানবিকতা কি সত্যি ফিরে আসবে? কী রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে তারা, যারা আগুন দিয়ে মানুষ মারে। দায় চাপানোর রাজনীতি বেশ পুরোনো একটি অভ্যাস। আর এই দায় চাপানোর প্রবণতার কারণেই প্রকৃত তদন্ত অনেক সময় সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে সঠিক বিচার পাওয়া যায় না। এলিনার পরিবার কি সত্যি বিচার পাবে? ধরে নিলাম বিচার পাবে। কিন্তু যে সংকটের কারণে এলিনার প্রাণ গেল, সেই সংকটের কি সমাধান হবে? সেই সংকটের সমাধান কি আসলেই সহজ? নাকি সংকট আরো ঘনীভূত হবে? নাগরিক মনে অনিশ্চয়তার জায়গাটি কি তবে থেকেই যাবে?

এলিনা বোন আমার, তোর জন্য এই অসহায় ভাইটি দুফোঁটা চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কী করতে পারবে? তার তো ক্ষমতা নেই, এই অপরাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বন্ধ করার। পত্রিকায় দু-কলম লিখে মনের কষ্ট কিছুটা শেয়ার করতে পারব এটুকুই পাওয়া। আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিই, তখন তুই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তি। তোর আম্মার কাছে থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। খালা শরবত বানিয়ে তোর কাছে দিত। ভাইয়া বলে ডেকে শরবতের গ্লাসটি আমাকে দিয়ে যেতিস। সেই স্মৃতি খুব দগ্ধ করছে আমাকে। মেনে নিতে পারছি না তোর চলে যাওয়া। তুই তো চলে গেলি। কিন্তু কী বার্তা দিয়ে গেলি আমাদের? তোর দুধের শিশুর দায় কি রাষ্ট্র নেবে? রাষ্ট্র কি তার ভরণপোষণসহ সব দায় নেবে? যদি নেয় তবে সেটা বড় পাওয়া হবে। তোর নির্মম বিদায় কুণ্ডরাজনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। আগুনে পুড়ে তুই ভস্মীভূত হয়েছিস। কিন্তু কৃমিকীটে খাওয়া দগ্ধ লাশের চেহারার রাজনীতির কি সত্যি কোনো পরিবর্তন হবে? যারা অগ্নিসন্ত্রাস করল তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চাই তাদের। সাধারণ নাগরিকরা রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝতে চায় না। তাদের বোঝারও দরকার নেই। তারা সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুন্দর একটি জীবন নিয়ে বাঁচতে চায়। কঠোর পরিশ্রম করে আয়-রোজগার করে তারা দিন পার করতে চায়। রাজনীতির জটিল অঙ্ক শেখার তাদের কোনো প্রয়োজন হয় না। তাদের যেটা প্রয়োজন হয় সেটা হলো নিরাপত্তার সঙ্গে চলাফেরা করা। ট্রেন ভ্রমণকে নিরাপদ ভ্রমণ হিসেবেই গণ্য করা হয়। পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করবে সেটা তো আরো বেশি আনন্দের। এলিনাদের বাড়ি রাজবাড়ী রেলস্টেশনের কাছেই। এলিনার বাবা রেলে চাকরি করতেন। এলিনার বাবার দীর্ঘ জীবন কেটেছে ট্রেনে। আর সেই ট্রেনে পুড়েই মরতে হলো তার কন্যাকে। এলিনা আজ নেই। আমার খালার শূন্য বুকে কে একটু শান্তির পরশ এনে দেবে? তার বুকফাটা আর্তনাদ কি রাষ্ট্রের গহিনে পৌঁছাবে? এলিনার মা কি দেখে যেতে পারবেন তার কন্যার প্রাণের বিনিময়ে রাষ্ট্রের ভালো কিছু? আর কোনো অগ্নিসন্ত্রাস আমরা দেখতে চাই না। এসব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের কাছে একটাই চাওয়া আর সেটা হলো এলিনা হত্যার সুষ্ঠু বিচার ও এলিনার পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

লেখক : কবি ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close