মো. জিল্লুর রহমান

  ০৯ জানুয়ারি, ২০২৪

বিশ্লেষণ

আতশবাজি পরিবেশ ও পাখিদের জন্য উদ্বেগজনক

সাম্প্রতিক কিছু বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও খ্রিস্টীয় নববর্ষ উদযাপনে ব্যাপকভাবে আতশবাজি, পটকা ফোটানো, ফানুস ওড়ানো ইত্যাদি ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে, যা মানুষ, পরিবেশ ও প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতি করছে। অগ্নিকাণ্ডের মতো বড় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাও ঘটছে। ভয়াবহ শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোগী, বৃদ্ধ, শিশু ও পাখিরা। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষের যেন কোনো বোধশক্তি ও কাণ্ডজ্ঞান নেই। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষেধাজ্ঞা, সাধারণ সচেতন মানুষজনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সবকিছু উপেক্ষা করে প্রতি বছরই তারা এগুলো করেই যাচ্ছে।

এ বছর ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টার পর থেকেই ঢাকার আকাশে আলোর ঝলকানি শুরু হয়। রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আতশবাজির বর্ণিল আলোতে আলোকিত ছিল ঢাকার আকাশ। তবে মুহুর্মুহু কান ফাটানো শব্দে বিরক্ত হয়েছে রাজধানীর বাসিন্দারা। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের বিরক্তির কথা প্রকাশ করেছে। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েক বছর ধরেই ইংরেজি নববর্ষ উদ্?যাপনের রাতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে আতশবাজি না করতে ও ফানুস না ওড়াতে নির্দেশনা দিয়ে আসছে। এর আগে ফানুস ওড়ানো ও আতশবাজি ফোটানোকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। গত বছর ফানুসের আগুনে মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ২০২২ সালের থার্টিফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানোর কারণে প্রায় ১০০টি স্থানে আগুনের ঘটনা ঘটে।

নতুন বছর ২০২৪ সালের প্রথম দিন সকাল ৮টায় বিশ্বের ১০৯ শহরের মধ্যে ঢাকা বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল এবং এ সময় আইকিউ এয়ারের বাতাসের মানসূচকে ঢাকার স্কোর ছিল ২৪৬। এ স্কোরকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলে গণ্য করা হয়। এর আগের দিন অর্থাৎ ২০২৩ সালের শেষ দিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) সূচকে ঢাকার স্কোর ছিল ২৪২ এবং এ স্কোরও খুব অস্বাস্থ্যকর। ২০২৪ সালের প্রথম দিন বিশ্বে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে চীনের চেংডু ও ভারতের দিল্লি। এ দুই শহরের স্কোর যথাক্রমে ২১৭ ও ২১৩। বায়ুদূষণের এ পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে।

খবরে প্রকাশ পাখিপ্রেমিক সংগঠন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এ বছর বর্ষবরণের রাতের বিকট শব্দে ও বায়ুদূষণের কারণে আটটি জায়গায় শতাধিক পাখির মৃত্যু হয়েছে। বর্ষবরণের রাতে ফানুস ওড়ানো, আতশবাজি ও পটকা ফাটানোর আনন্দ-উল্লাস অনেকের জন্য বিপদ ডেকে এনেছিল। এতে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ বড় শহরের বায়ু ও শব্দদূষণ তীব্র হয়ে ওঠে। অসুস্থ রোগী, শিশু ও প্রবীণ মানুষরা অনেকেই অস্বস্তি ও অসুস্থ বোধ করেন। তবে যে পরিমাণে শব্দ ও বায়ুদূষণ হয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে শহরের পাখিগুলো। এ বছর বর্ষবরণের রাতে শুধু ঢাকা শহরেই চার প্রজাতির শতাধিক পাখি মারা গেছে। আর কমপক্ষে চার প্রজাতির পাখি ভয় ও আতঙ্কে বাসা থেকে উড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল। বেশ কিছু এলাকায় পাখিরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মৃত্যু পাখিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল চড়ুই। এরপর কাক, বাতাসি ও ঘরবাতাসি পাখির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি মারা গেছে মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকা, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও জাতীয় চিড়িয়াখানা, তেজগাঁও সাতরাস্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া, ওয়ারি ও সদরঘাট এলাকায়। আর বিকট শব্দে বাসা থেকে বেশি পালিয়েছে টিয়া, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, খঞ্জন ও শালিক পাখি।

এমনিতেই ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের একটি অন্যতম জনবহুল ও অপরিকল্পিত মহানগর। হাসপাতালে যখন চিকিৎসা চলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন পাঠদান চলে, তখন রাস্তায় দেখা যায়, একদল লোক রাস্তায় মাইক দিয়ে কেউ বক্তৃতা দিচ্ছে, মাইক দিয়ে গান বাজিয়ে লটারির টিকিট বিক্রি করছে, কারণে-অকারণে বাস ও ট্রাকচালকরা হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে বাইরে থেকে হাসপাতালের ভেতর শব্দদূষণ করছে, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের গগনবিদারি শব্দ প্রতিনিয়ত মানুষকে বিব্রত করছে। এসব চিত্র অত্যন্ত বিব্রতকর ও উদ্বেগজনক এবং এর থেকে নিস্তার দরকার। মনে হয় যেন এগুলো দেখার ও তদারকির কেউ নেই!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একদল গবেষকের নেতৃত্বে ঢাকার বর্ষবরণের রাতের বায়ুর ৪৮টি স্থানের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় এবার ফানুস ওড়ানো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। অর্ধেকে নেমেছে আতশবাজি ও পটকা ফাটানো। ফানুস ওড়ানো সবচেয়ে বেশি কমেছে। এতে সামগ্রিকভাবে গত বছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশ দূষণ কম হয়েছে। তবে তা-ও ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি। ওই পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দোলাইরপাড়, আনন্দবাজার, নীলক্ষেত ও নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকটি এলাকায় বায়ুদূষণ ছিল গত বছরের মতো বেশি। অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে ফার্মগেট, তেজগাঁও ও মহাখালী এলাকায় বেশি বায়ুদূষণ ছিল। উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ প্রধান আবাসিক এলাকাগুলোয় বায়ুর মান খুব বেশি খারাপ হয়নি। শব্দের মানও স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেশি ছিল।

অন্যদিকে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বর্ষবরণের রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত আতশবাজি পোড়ানো এবং পটকা ফাটানোর শব্দ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দ হয় সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, রাতের বেলা রাজধানীতে শব্দের মানমাত্রা ৫০ ডেসিবেলের মধ্যে থাকতে হবে। কিন্তু রাতের ৯০ শতাংশ সময় ওই মাত্রা ৭০ ডেসিবেলের ওপরে ছিল, যা প্রতিদিনের গড় মাত্রার চেয়ে ৪২ শতাংশ বেশি। একই সময়ে বায়ুর মান ৩৫ শতাংশ অবনতি হয়। রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে বায়ুতে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ৯১ মাইক্রোগ্রাম বেড়ে যায়, যা ওই সময়ের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। তবে গত বছর একই সময়ের তুলনায় ১ মাইক্রোগ্রাম কম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক বাড়িতে ও শোবার ঘরে শব্দের মাত্রা ২৫ ডেসিবল, অন্যান্য রুমে ৪০ ডেসিবল, হাসপাতালে ২০ থেকে ৩০ ডেসিবল, রেস্টুরেন্টে ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল, অফিস কক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ ডেসিবল এবং শ্রেণিকক্ষে ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবল থাকা স্বাস্থ্যসম্মত। এর চেয়ে বেশি হলে সেটা শব্দ দূষণের পর্যায়ে পড়ে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সূত্রে জানা যায়, ৩০টি কঠিন রোগের কারণ বারো ধরনের পরিবেশ দূষণ। শব্দদূষণ এর মধ্যে অন্যতম একটি। স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেল বা তার বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অস্ট্রেলিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, উচ্চশব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চশব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শব্দদূষণের কারণে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, খিটখিটে মেজাজ, মাথাব্যথা, পেপটিক আলসার, অস্থিরতা, অমনোযোগী ভাব, ঘুমে ব্যাঘাত, শ্রবণশক্তি ও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।

এসব বিষয় মাথায় রেখেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বছর কঠোর বার্তা প্রদান করে। ফানুস ওড়ানো ও আতশবাজি কিংবা বিক্রির সময় হাতেনাতে ধরা পড়লেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক বার্তা জারি করে ডিএমপি। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষও এবার ফানুস না ওড়াতে অনুরোধ করে। তা ছাড়া, বিভিন্ন সংগঠন থেকেও আতশবাজি না করার অনুরোধ করে প্রচার চালানো হয়। পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন (পি’ ফাউন্ডেশন), সেভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশ, ওয়াইল্ড ওয়াচ, স্টেলা ফাউন্ডেশন, সেভ ফিউচার বাংলাদেশ নামের সংগঠনগুলো বর্ষবরণের আগে এক জনসচেতনতামূলক সমাবেশে জানায়, আতশবাজি বা পটকাবাজি মূলত তিন ধরনের ক্ষতি করে। এগুলো ফোটানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হয়, যা চারদিকে শব্দদূষণ ঘটায়। এই শব্দ শিশু, বৃদ্ধসহ রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা থাকে। আতশবাজির শব্দে প্রাণীরা চমকে ওঠে। এ কারণে প্রতি বছর হাজারো পাখি ও বন্যপ্রাণী অসুস্থ হয়ে মারা যায়। পথে থাকা কুকুর-বিড়াল ভয়ে ছোটাছুটি করে, আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া এ থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটায়, যা ফুসফুসের নানা রোগের কারণ।

ঢাকা মহানগরসহ দেশের বড় বড় শহরে পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে শব্দদূষণ। উচ্চ শব্দদূষণের কারণে প্রাণিকুল আজ বিলুপ্তির পথে, শহর আজ পাখিশূন্য। ঢাকায় সৃষ্ট শব্দদূষণে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার শিশুর শ্রবণক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে বা কমছে। বাড়িতে, অফিসে, রাস্তাঘাটে, বিপণিকেন্দ্রে, বাস ও রেলস্টেশনের মাধ্যমে শব্দদূষণ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। খ্রিস্টীয় নতুন বছরকে বরণ করে নিতে রাত ১২টা বাজার আগেই রাত ১১টা থেকে একযোগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ছাদ থেকে আতশবাজি পোড়ানো হয়। ওড়ানো হয় ফানুস। রাজধানীর সব এলাকার আকাশ ভরে ওঠে বর্ণিল আলোয়। গবেষকরা বলছেন, বর্ষবরণের রাত মানেই আতশবাজি আর পটকা ফাটানো নয়। এতে কিছু মানুষের আনন্দ হয় ঠিকই, কিন্তু শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষের জন্য গুরুতর ক্ষতি ডেকে আনে। এটা অনেকে বুঝতে পেরেছেন। তাই এবার সচেতনতা বাড়ায় শব্দ ও বায়ুদূষণ কমেছে। তবে আগামী বছরগুলোয় এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে আরো সোচ্চার হতে হবে। নাগরিকদের হতে হবে আরো সচেতন ও দায়িত্বশীল।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

[email protected],

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close