মোহাম্মদ কবীর মোল্লা

  ২৭ মে, ২০২৩

মতামত

ভিক্ষাবৃত্তি মহামারির মতোই ভয়ংকর

একটি দেশের মোট জনশক্তির বেশির ভাগেরই কর্মশক্তি কাজে না লাগাতে পারলে সে দেশ এগোতে পারে না। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অনেকাংশ বেকার আর ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত। শারীরিকভাবে সক্ষম, দৃষ্টিশক্তি থাকা সত্ত্বেও করছে ভিক্ষাবৃত্তি। হাঁটাচলা করতে পারা মানুষের ভিক্ষা প্রার্থনাকে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরুৎসাহিত করা হলেও সুস্থ স্বাভাবিক ভিক্ষুকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। ব্যস্ত সড়কের মোড়ে, মাজার-দরগা, অফিস-আদালতের পাশে কিংবা জনবহুল প্রতিটি স্থানেই ভিক্ষা প্রার্থীর আনাগুনা, গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে সাহায্য চাওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যেখানে শারীরিকভাবে উপার্জনক্ষম মানুষের চেয়েও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সংখ্যা বেশি। যাদের মধ্যে দশ বছর বয়সের কম শিশু থেকে শুরু করে পঞ্চাশোর্ধ্ব বহু মানুষ আছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, দেখতে অনেক সুদর্শন, কিন্তু মুখ লুকিয়ে হাত পেতে সাহায্য নিচ্ছেন রাস্তার দুপাশে বসে। এদের মধ্যে অনেকেই চুরি, ছিনতাই, মাদক বহনসহ নানা প্রকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারেরর দৃশ্যমান নানামুখী কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, বিপরীতে নানামুখী সমস্যার মধ্যে অন্যতম সক্ষমণ্ডঅক্ষম মানুষের ভিক্ষাবৃত্তি।

ভিক্ষাবৃত্তিবিরোধী সরাসরি কোনো আইন এখনো প্রণীত হয়নি। তবে এটি নিয়ন্ত্রণ কিংবা পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে ‘ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ আইন’র আওতায়। যদিও ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে কাজে আসছে না ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ আইনও। প্রণয়নের একদশক অতিবাহিত হলেও এর কোনো সুফল মেলেনি। ২০১১ সালে প্রণীত হয় ‘ভবঘুরে পুনর্বাসন আইন’। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ আইনটি এখন পর্যন্ত কার্যকর করা যায়নি।

আইনটির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও পুনর্বাসনের প্রশ্নে রয়েছে অস্পষ্টতা। পেশাদার ভিক্ষুক সংখ্যা বৃদ্ধির এটি বড় একটি কারণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের খসড়া প্রণয়নকারীদের অদূরদর্শিতা, আইন কার্যকরে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদিচ্ছা এবং বিধি না হওয়ার কারণেই আইনটির সুফল মিলছে না।

ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১১-তে বলা হয়েছে, যে নিজে বা কারো প্ররোচনায় ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত, সে ভবঘুরে হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে ভবঘুরেদের আটক করার বিধান রাখা হয়েছে। আইনে আরো বলা হয়েছে, ভবঘুরেকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। আর আটক ব্যক্তি ভবঘুরে হলে ম্যাজিস্ট্রেট যেকোনো আশ্রয়কেন্দ্রে কমপক্ষে ২ বছর তাকে আটক রাখার জন্য অভ্যর্থনা বা আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেবেন।

আইনে ভাসমান জনগোষ্ঠীকে ‘ভবঘুরে’ এবং ‘আশ্রয়হীন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও তাদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনে স্পষ্ট কোনো বিধান রাখা হয়নি। ২০১১ সালে প্রণীত ‘ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি পুনর্বাসন আইন’র ১০(৩)(খ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ভবঘুরে হিসেবে প্রমাণিত হলে, তাকে অনধিক ২ বছরের আটকাদেশ দেওয়া যাবে। কিন্তু পুনর্বাসনের বিষয়ে আইনটির ১৮(১) ধারায় সংক্ষেপে বলা হয়েছে, আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত ভবঘুরে ব্যক্তির পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়নের উদ্দেশে যথাযথ ব্যবস্থা প্রহণ করবে।’ এখানে ‘নির্ধারিত পদ্ধতি’ বলা হলেও আইনের কোথাও কোনো পদ্ধতির উল্লেখ নেই। এ ছাড়া ধারায় উল্লিখিত ‘যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ’ বলতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটিও স্পষ্ট নয়। আইনের দৃষ্টিতে ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ শব্দটি অনির্ধারিত ও অস্পষ্ট বলেই বিবেচিত। আইনে আটককালীন মেয়াদে তার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বৃৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের কোনো বিধান রাখা হয়নি। এমনকি আটকের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে সরকারি বা বেসরকারি সহায়তায় পুনর্বাসনের কোনো বিধান রাখা হয়নি। ফলে আটক ভবঘুরেদের আটকের মেয়াদ শেষে বৈধ কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ নেই। এতে আটক ভিক্ষুকরা তাদের আটকের মেয়াদ শেষে আবারো ভিক্ষাবৃত্তিতেই ফিরে যায়। মোবাইল কোর্ট তাদের বারবার আটক করলেও ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হচ্ছে না। ফলে ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখছে না।

যারা সত্যিই উপার্জনক্ষম এবং পরিবারে উপার্জন করার মতো কেউ নেই, তাদের ভিক্ষা প্রার্থনা স্বাভাবিক হলেও সুস্থ সবল মানুষের ভিক্ষা প্রার্থনা কাম্য নয়। সুস্থ মানুষের ভিক্ষাবৃত্তি মহামারির মতোই ভয়ংকর। কেননা পরিশ্রম করার মতো সামর্থ্য আছে এমন মানুষকে কর্মে নিয়োজিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে ধর্মীয়ভাবে, কাজ যতই ছোট হোক তাকে ছোট মনে করতে নেই বরং সৎপথে উপার্জনের যৎসামান্য অর্থও মহামূল্যবান, কিন্তু সুস্থ-সবল মানুষ কেন ভিক্ষাবৃত্তিতে আকৃষ্ট হচ্ছে তার একটা দৃশ্যমান কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের কাছে হাত পাতলেও এখানে কোনো ঝামেলা নেই বরং ভালোই আয় হয়, এ ভাবনা থেকে মানুষগুলো ভিক্ষাবৃত্তিতে নামলেও তা কাম্য নয়। পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তির আড়ালে অপরাধজনক কর্মকাণ্ডেও লিপ্ত হচ্ছেন অনেকে, ভিক্ষুক বিধায় সন্দেহ করে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর সুযোগ নিচ্ছেন তারা। বিশেষ করে সুস্থ সবল পুরুষ-মহিলা নিজেদের চেহারা ও পোশাকে নিরীহ রূপ ধারণ করে তাদের শিশুসন্তানসহ ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হচ্ছে। নিজেদের তারা ভিক্ষুক হিসেবে মেনে নেওয়ার পাশাপশি কোমলমতী শিশুদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির শিক্ষা দিয়ে বিপথগামী করছে। পুঁজিবিহীন ও চিন্তাহীন ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে সহজে টাকা পাওয়ার কারণে ভিক্ষুকদের দেখে অন্যরাও ভিক্ষাবৃত্তিতে আকৃষ্ট হচ্ছে। দিন দিন সুস্থ-সবল ভিক্ষুকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মহামারির মতো ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে।

যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়, তাদের মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক নারী-পুরুষরা কেন কোনো কাজের ব্যবস্থা না করে মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা নিচ্ছে এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। মহিলাদের বাসা-বাড়িতে কাজ করতে গেলে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হলেও গৃহস্থালির কাজ ছাড়াও গার্মেন্টসহ বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে কাজ করার সুযোগ থাকে। অধিকন্তু বহু নির্মাণ শ্রমিকও আছে যারা নারী, কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন, তবুও কারো কাছে হাত পাততে রাজি নন তারা। পুরুষদের জন্য আছে আরো বহু কাজের সুযোগ, তারাও সেদিকে না গিয়ে সহজ আয়ের রাস্তা হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকে

বেছে নিয়েছেন অথচ বহু মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরা রিকশা চালানো, নির্মাণ শ্রমিক, নিরাপত্তাকর্মী, ছোটখাটো বহু ব্যবসা, দৈনন্দিন ভিত্তিতে বহু কাজসহ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ, তবে বাস্তবতা হলো এক শ্রেণির ব্যক্তি ধনী থেকে আরো ধনী হচ্ছে, বিপরীতে হতদরিদ্র এবং মধ্যবিত্তরা একই জায়গায় থাকছে, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না তেমন, আর ভিক্ষুক-ভবঘুরেরা যেমন ছিল তেমন অবস্থায় দিনযাপন করছে। একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের নানা উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম হতে পারে দেশকে ভিক্ষুক-ভবঘুরে মুক্ত করা, বাংলাদেশে বিদ্যমান বিভিন্ন মাজার-দরগায়, অফিস-আদালতের সামনে এবং জনবহুল জায়গাগুলোতে অসংখ্য ভিক্ষুক আছে, যারা রাস্তায় বসে ভিক্ষা করে এবং রাস্তাতেই রাত্রী যাপন করে, এসব মানুষদের পুনর্বাসন করার কোনো বিকল্প নেই।

সরকারি পুনর্বাসনের আওতায় কেন ভিক্ষুকরা আসতে চায় না- এর কারণ অনুসন্ধানে মিলেছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। অন্য সাধারণ পেশা থেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে আয় বেশি। ভিক্ষাবৃত্তি পেশা হিসেবে স্বীকৃত না হলেও এটির সামাজিকভিত্তি

বেশ মজবুত। কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই। মর্যাদা এবং সামাজিক লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে হাত বাড়াতে পারলেই হলো- মিলতে থাকে ভিক্ষা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায়ই চলে ভিক্ষাবৃত্তি।

ভিক্ষাবৃত্তি চলে গেছে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিয়ন্ত্রণ করছে ভিক্ষুক-বিচরণ এলাকা। রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নতি করার দায়িত্ব সরকারের ওপর হলেও নাগরিকদেরও থাকে কিছু দায়িত্ব। শিক্ষিত নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকলেও সরকার নাগরিকদের যোগ্যতানুসারে বিভিন্ন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন। তবে লেখাপড়া না জানা নারী পুরুষদের জন্য বহু কর্মসংস্থান থাকলেও তাদের মধ্যে যারা ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজকে জীবনসঙ্গী করেছে, এর দায় একান্তই ব্যক্তির ওপর, ব্যক্তির অনিচ্ছা ও সদইচ্ছা না থাকার কারণেই কর্মের দিকে ছুটে না গিয়ে সহজ পন্থায় আয় করার পথ হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছেন, যা কাম্য নয়। এই শ্রেণির মানুষদের কর্মে আগ্রহী করার জন্য জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে ব্যক্তি উদ্যোগে কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। ভিক্ষা প্রার্থী কোমলমতি শিশুদের পড়ালেখার ব্যবস্থা ও তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা শারীরিক অক্ষমতার কারণে আয়-রোজগার করার মতো অবস্থায় নেই, তাদের সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য সব ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে, দুস্থ নাগরিকদের ভালো রাখার সব দায়িত্ব সরকারের। সেই সঙ্গে প্রতিটি নাগরিক, তার ওপর অর্পিত নাগরিক দায়িত্ব এবং দরিদ্র-অসহায় মানুষের প্রতি ধর্মীয় নির্দেশনা পালন করলে দেশ থেকে দূর হবে ভিক্ষাবৃত্তি এবং সত্যিকার অর্থেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

লেখক : কানাডা (মন্ট্রিয়েল) প্রবাসী ও সাংস্কৃতিককর্মী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close