মো. আনোয়ার হোসেন

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের দাবি

শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষাই মুক্তি অর্থাৎ দেশের অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে শিক্ষা। একটি দেশকে সার্বিক দিক থেকে পুনর্গঠিত করতে ৫০ বছরকে মোটেও কম সময় বলা যাবে না। সেদিক বিবেচনায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও এর কাঠামোকে আদ্যপান্ত সাজানোর মতো যথেষ্ট সময় পেয়েছি এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, আমাদের দেশে ১১ বছর বয়সে একটি শিশু যা শিখে তা বিশ্বের মান অনুসারে সাড়ে চার বছরে শেখার সমান।

বাংলাদেশের শিক্ষার ধরন যতটা সহজ করা জরুরি, ততটা বাস্তবমুখী করা হয়নি। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা স্কুলের প্রতি উদাসীন। শিক্ষা এখানে আনন্দের উপকরণ নয় বরং একটা রেট রেসের নাম। আমাদের বাস্তব জীবনে কাজে লাগে এমন দক্ষতাপূর্ণ কার্যক্রমগুলো কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বছরের শিক্ষাজীবনেও স্কুল বা কলেজ শেখাতে পারে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ব্যর্থ। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সিট গলধঃকরণের নালিপথ হিসেবে কাজ করেন। এতে অনেক পরিশ্রম ও সময় ব্যয় করেও অশ্বডিম্ব প্রসব করে শিক্ষার্থীরা। ভালো প্রেজেন্টেশন, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড বা এক্সেলের কাজ, গুছিয়ে ই-মেইল লেখা এবং দ্রুত টাইপিং আমাদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত নয়। এগুলো নিজেকে আলাদাভাবে শিখতে হয়। কুইক লার্নিং এবিলিটি ও টিম ওয়ার্ক নিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো কাজ করা হয় না। এ কারণে অনার্স বা মাস্টার্স শেষে একজন শিক্ষার্থী চাকরির মহাসাগরে নামলে নিজেকে সে আবিষ্কার করে নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থায়। তখন মনে হয় তার মেধার ঝুলি আসলে ফাঁকা।

সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলভাবে কম। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও এত অল্প বেতন আর কোনো দেশেই মনে হয় পাওয়া যাবে না। দশম গ্রেডের একজন সহকারী শিক্ষক ১৪ থেকে ১৫ বছরেও পদোন্নতি পান না। একদিকে বলা হয় শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর। অন্যদিকে শিক্ষকরা তাদের অধিকার আদায়ে রাজপথে নামলে পুলিশের জল কামানের মুখে পড়েন। ফলে মেধাবীদের আমরা দেশে ধরে রাখতে পারি না। উচ্চ শিক্ষার্থে তারা পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে, পাচার হচ্ছে মেধা।

মোদ্দাকথা হলো শিক্ষার পেছনে বড় অঙ্কের বাজেট রাখা প্রয়োজন। উন্নয়নের যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হয়। বিশ্বের যেসব দেশ উন্নতি করেছে এবং করছে, যাদের দেখে আমরা কিছুটা অবাক হই বা ঈর্ষা পোষণ করি, তারা সবাই শিক্ষাই সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে। অনেক সময় সাধ্যের বাইরে গিয়েও করেছে। যেমন- কিউবা ও কোরিয়া। দীর্ঘদিন থেকে কিউবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। এতে তার অর্থনীতি খুবই লাজুক অবস্থায় পরেছে। কিন্তু দেশটি শিক্ষা খাতে বিনিয়োগে এক পাও পিছপা হয়নি। এর সুফল তারা এখন পাচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে কাছে পেতে চায়। কয়েক বছর ধরে দেশটি তার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯ শতাংশ বরাদ্দ দিচ্ছে শিক্ষায়।

অন্যদিকে আমাদের দেশের মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ বরাদ্দ থাকে শিক্ষা খাতে। কোনো কোনো বছর এর চেয়েও কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি অনুপাতে শিক্ষা খাতে ১ দশমিক ৮৩ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। শতাংশের অঙ্কে যেটি কিনা নেপালের চেয়েও কম। অথচ শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে দেশের মোট বাজেটের অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবীদ আর্থার শুলজ ও রবার্ট সোলো দেখিয়েছেন, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চশিক্ষায় ১১ শতাংশ।

উচ্চশিক্ষার সূতিকাগার বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। এখানে গবেষণা ও নতুন নতুন আবিষ্কার হবে, হবে মেধাবীদের মিলনমেলা। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য যে বাজেট বরাদ্দ থাকে, এর থেকে বেশি টাকা একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর অতিথি আপ্যায়নে খরচ করে। রাজনীতিতে কলুষিত হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ। হলের আসন পেতে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে করতে হয় দহরমণ্ডমহরম সম্পর্ক। ছাত্রদের কথা বাদই থাকুক। শিক্ষকরা পর্যন্ত দলাদলিতে জড়িয়ে আছে সেই নব্বইয়ের দশক থেকে। দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যখন তার ক্যান্টিনের চা, চপ আর সিঙ্গারা নিয়ে গর্ব করেন তখন বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কতটা তলানিতে নেমেছে। উচ্চশিক্ষা মূলত গবেষণাধর্মী শিক্ষা। কিন্তু উচ্চশিক্ষাতে গবেষণা নেই বললেই চলে। গবেষণার জায়গায় স্থান পেয়েছে সরকারি চাকরিপ্রাপ্তির লক্ষ্যে পড়াশোনা। শিক্ষকরা ব্যস্ত রাজনীতি ও বিভিন্ন লবিংয়ে। বিষয়জ্ঞান অর্জন থেকে শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছে বহুদূরে। শিক্ষা খাতে পরিবারের ব্যয়ই বেশি। ফলে স্কলারশিপ ব্যতীত নিম্নবৃত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।

ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার, নেপাল মিয়ানমার যেখানে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে সেখানে বাংলাদেশে এই হার মাত্র ৫০ শতাংশ অর্থাৎ আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেক শিক্ষকই প্রশিক্ষিত নয়। আমাদের চারপাশে প্রচুর শিক্ষিত মানুষ কর্মহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের অনার্স বা মাস্টার্স ডিগ্রি আছে, গ্রেড পয়েন্টও যথেষ্ট ভালো। কিন্তু তারা চাকরি পাচ্ছেন না। কারণ চাকরির বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দক্ষতা তাদের নেই। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান তারা আহরণ করেছে ঠিকই কিন্তু সেই জ্ঞান তারা কোনো কাজে লাগাতে পারছে না। শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটা বাজে ব্যাপার হচ্ছে, শুধু চাকরি পাওয়াটাকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বানিয়ে ফেলা। বিসিএসের নেশায় পরে জীবন থেকে অনেকগুলো বছর হারিয়ে ফেলছে অজস্র তরুণ-তরুণী। এই সময় ও শ্রম তারা অন্য কোথাও দিলে এর থেকে অনেক ভালো কিছুই করতে পারত।

শিক্ষা পণ্যের উচ্চ মূল্য, বাজেটে শিক্ষা খাত উপেক্ষিত থাকা, গবেষণা কার্যক্রমে স্থবিরতা, অবহেলিত বিজ্ঞান শিক্ষা, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, দলীয়করণ, বাড়তি ফি আদায়, ভর্তি বাণিজ্য, শিক্ষক সংকট, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন, দেশি-বিদেশি প্রেসক্রিপশনে শিক্ষা খাতকে আবদ্ধ করা, পশ্চাৎপদ মাদরাসা শিক্ষা, সার্টিফিকেট বাণিজ্য এরকম আরো হাজারো সমস্যায় জর্জরিত আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা। এগুলো কাটিয়ে ওঠা এখন সময়ের দাবি।

সম্প্রতি (১৬ জানুয়ারি ২০২৩) অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা জেএসসি এবং জেডিসি বাতিলের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি দেওয়া নিশ্চয়ই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু সরকার শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। যে দেশে স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও এক-চতুর্থাংশ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত সেখানে সরকার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে শিক্ষার উন্নয়ন কতটুকু সম্ভব সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। এজন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দৃঢ় কাঠামোয় সাজাতে হবে। এতগুলো মিডিয়াম বা শিক্ষা পদ্ধতি না রেখে সবাইকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা মাদরাসা কারিকুলাম নিয়ে প্রচুর কাজ করতে হবে। এর সুফল হয়তো সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আজ থেকেও যদি কাজ শুরু হয় তাহলে ২০ থেকে ২৫ বছর পরে এ দেশের প্রেক্ষাপট বদলে যাবে। কারণ আজ যারা শিক্ষার্থী তারাই জাতির নেতৃত্বে থাকবে। আলোর মশালবাহী অগ্রদূতের মতো তারাই এগিয়ে নেবে দেশ ও বিশ্বকে।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close