সৈয়দ মো. জাহেদুল ইসলাম

  ০৯ মে, ২০২২

বিশ্লেষণ

রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমানে চলমান নানাবিধ সমস্যার মাঝে অন্যতম বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট। উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ফিরে যাওয়াটা এখন সময়ের দাবি। এককভাবে এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সরবরাহের সক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের নেই। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রতিনিয়ত কমে আসছে, সেইসঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠছে চরম অব্যবস্থাপনা। বিভিন্ন ক্যাম্পের কাঁটাতার ভেঙে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাচ্ছে জেলা শহরে এবং নিজেদের সম্পৃক্ত করছে নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে। উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ৩৪টি ক্যাম্পের ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে মাত্র দুই হাজার আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। যার ফলে চাইলেও এসব রোহিঙ্গা শিবিরে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে জিরো পয়েন্ট অঞ্চলে অবাধে চলছে ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য। প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটক হচ্ছে রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরীরা। দিনের বেলা স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও প্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শনের সুযোগ থাকলেও, রাতের অন্ধকারে এসব এলাকা অনেকটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের যে খাদ্যদ্রব্য প্রদান করে তারা স্থানীয় বাজারে এসব কম দামে বিক্রি করে দেয়, যার ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাশাপাশি ন্যূনতম মজুরিতে রোহিঙ্গারা যেকোনো কাজ করে বলে স্থানীয়রা কর্মহীন হয়ে বসে থাকে। এত কিছুর পরও তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা সাধারণ জনগণ কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। রাতের অন্ধকারে এসব রোহিঙ্গারা সশস্ত্র হামলা করে স্থানীয়দের ক্ষতি করতে পারে বলে তারা নীরবে এসব সয়ে যায়।

উল্লেখ্য ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৩০টি পুলিশ ও সেনা চৌকিতে হামলা করে প্রায় ১২ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। আরসা যোদ্ধাদের এমন অতর্কিত হামলার জবাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে শুরু হয় ‘অপারেশন ক্লিয়ারেন্স নামে বর্বর সেনা অভিযান। এই অপারেশনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাপানিদের যুদ্ধনীতি অনুসরণ করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল সবাইকে হত্যা করা, সবকিছু জ্বালিয়ে দেওয়া এবং সবকিছু লুট করে নেওয়া। রোহিঙ্গাদের ওপর এমন বর্বর হামলার পর উপায়ান্তর না পেয়ে তারা দলে দলে বাংলাদেশের সীমান্তে এসে ভিড় করতে শুরু করে। বিশ্বের তাবৎ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো সেসময় রোহিঙ্গাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অথচ বাংলাদেশকে অনুরোধ করে যেন তাদের জন্য বর্ডার খুলে দেওয়া হয়। সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে এসে অনাহারে, অর্ধাহারে দিনাতিপাত করা এসব রোহিঙ্গাদের দেখে মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্ডার তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর রোহিঙ্গাদের যে ঢল বাংলাদেশে আসা শুরু করে তার বর্তমান সংখ্যা এখন ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান দেওয়া, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা, পরিচ্ছন্ন স্যানিটেশন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা মোটেও সহজ বিষয় নয়।

উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলো নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত এই দুই ভাগে বিভক্ত। মূলত ৭০-এর দশক, ৯০-এর দশক ও ২১ শতকের শুরুতে যেসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তারা এসব নিবন্ধিত ক্যাম্পে বসবাস করে। যারা ২০১৭ সালের পর বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তারা সবাই অনিবন্ধিত ক্যাম্পের বাসিন্দা এবং আকারের দিক থেকে এদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। উখিয়ার কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্প (কেআরসি) এবং টেকনাফের নয়াপাড়া রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের (এনআরসি) অনেক শিশু, কিশোর ও বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। যারা চার দশক আগে বাংলাদেশে এসেছে তাদের শিক্ষা, বেড়ে ওঠা, বিয়ে সবকিছু এখানেই হয়েছে। যার জন্য এসব রোহিঙ্গারা নিজেদের বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে এবং তারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে দৃঢ়ভাবে নারাজি প্রকাশ করে। নতুন রোহিঙ্গাদের আগমনে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি এসব নিবন্ধিত ক্যাম্পের পূর্বতন রোহিঙ্গারাও নারাজ। কারণ এত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের পাশাপাশি যেসব নাগরিক সুবিধা তারা পেয়ে আসছিল, নতুন রোহিঙ্গাদের আগমনে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সার্বিক নিরাপত্তা ও নিজেদের হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দিলে নতুন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার প্রতি ইচ্ছা পোষণ করে। পুরোনো রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়দের মোটামুটি ভালো সম্পর্ক ছিল, যা নতুনদের আগমনে পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। স্থানীয় গ্রামগুলোতে এখন আর রোহিঙ্গাদের প্রবেশাধিকার নেই, ফলে পূর্বের সেই সংহতিও তাদের মাঝে অবশিষ্ট নেই। এর ফলে নতুন রোহিঙ্গা, পুরোনো রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মাঝে একটি ত্রিমুখী অবস্থান তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে তারা একটি গণ-জমায়েত করে। স্থানীয় ও জেলা প্রশাসনের ধারণার বাইরে গিয়ে এই গণ-জমায়েতে চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষ যোগদান করেছিল। এ সময়

বিভিন্ন এনজিওর অর্থায়নে তারা ডিজিটাল ব্যানারে তাদের দাবিগুলো ইংরেজিতে উপস্থাপন করে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ কামনা করে। বেশকিছু জায়গায় রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র অবস্থান পুরো প্রক্রিয়াকে ভয়াবহ করে তোলে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই গণ-জমায়েতকে বাংলা ও বাঙালির সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে একটি হুশিয়ারি বলে দাবি করেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে গিয়ে অবস্থান করে। নিত্যনতুন জামা আর অঙ্গভঙ্গি দেখে বুঝাই যায় না কে রোহিঙ্গা আর কে স্থানীয়। একমাত্র ভাষার ভিত্তিতে এই জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশিদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি, সৈকত পরিচালনা কমিটি, জেলা পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও বিচ কর্মীদের যৌথ অভিযানের মাধ্যমে হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের এই অঞ্চল থেকে প্রতিনিয়ত আটক করা হচ্ছে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের কাছে আর কোনো উপায় নেই। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে গঠন করা হয়েছিল আনান কমিশন। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রাখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবনা, আনান কমিশনের রিপোর্ট, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দাবি মূলত একই। যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো, হারানো সম্পদের ক্ষতিপূরণ, রোহিঙ্গাদের স্থানীয় স্বীকৃতি দিয়ে মিয়ানমারের সংবিধানে আইন প্রণয়ন, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় তাদের এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন ও আন্তর্জাতিক আদালতে অপরাধীদের বিচারের বিষয়গুলো। ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিকভাবে ৩৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চেয়েছে মিয়ানমার, কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে একজনও সেখানে যায়নি।

বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবনযাপন করছে রোহিঙ্গাদের চাপে। জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের রয়েছে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। পূর্বতন রোহিঙ্গারা যেভাবে নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক দাবি করে জাতীয় স্বীকৃতির প্রত্যাশা করে, একইভাবে নতুন রোহিঙ্গারাও যেকোনো সময় বাংলাদেশকে নিজেদের বলে দাবি করে বসতে পারে। টাকা থাকলে ক্ষমতা সামনে থেকেই আসে, আর রোহিঙ্গাদের মাঝে কী পরিমাণ টাকার ছড়াছড়ি তা রোহিঙ্গা নেতার কন্যার কান ফুঁড়ানো অনুষ্ঠানে লাখ টাকার স্বর্ণালংকার উপহার প্রাপ্তি থেকেই স্পষ্ট হয়। এ ছাড়াও গণ-জমায়েত করে তারা এরই মধ্যে প্রমাণ দিয়েছে নিজ স্বার্থে তারা কতটা ভয়ানক হতে পারে। প্রায় পাঁচ হাজার একর জমি ধ্বংস করে গড়ে ওঠা ১১ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় শিবির বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে ওঠার আগেই তাদের নির্জিব করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close