মাছুম বিল্লাহ

  ১২ জানুয়ারি, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

এনসিটিবিতে হচ্ছেটা কী!

দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ২০২৩ সালে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে নতুন বই। এই লক্ষ্যে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাইলটিং হবে প্রাথমিক স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির। প্রাথমিকের ১০০ ও মাধ্যমিকের ১০০ বিদ্যালয়ে পাইলটিং হওয়ার কথা, কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে ২০০টিতে নয়, ১০০-১২০টিতে পাইলটিং হবে।

আমরা এখন যে কারিকুলাম ব্যবহার করছি, সেটি ২০১২ সালে প্রণীত হয়েছে। প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির শিক্ষাক্রম নবায়ন করা হচ্ছে। অন্য শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হচ্ছে। পুরোপুরি নবায়ন করা হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম। কারিকুলাম হচ্ছে শিক্ষার পরিকল্পনা, বলা যায় মহাপরিকল্পনা। এটি যেনতেন কোনো কাজ নয়। এটি শুধু শিক্ষক বদলি, বই ছাপা আর বই বিতরণ নয়। এই বিষয়টি বুঝতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। শিক্ষক হলেই কারিকুলাম তৈরি করতে পারেন না। সরকারি চাকরি করলেই সবাই কারিকুলাম তৈরি করতে পারেন না। দেখা যায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি শিক্ষকদের বদলি করে এনসিটিবিতে পাঠানো হয়। এনসিটিবিতে এসে তারা কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ হয়ে যান। অথচ বদলি হয়েছেন তদবিরের জোরে, ধরা করার কারণে কিংবা আরো কোনো শক্তিশালী কারণে।

এনসিটিবি কারিকুলামের সঙ্গে জড়িত থাকতে হবে শিক্ষাবিদ, যারা প্রকৃত অর্থে পড়াশোনা করেন, পড়াশোনা জানেন, পড়াশোনা নিয়ে, দেশের শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। পদ দেখে, পজিশন দেখে এগুলো নির্বাচিত করা হয় বলে এত দূরবস্থা এনসিটিবির। এনসিটিবিতে যাদের বদলি করা হয়, তারা সবাই সরকারি কলেজের শিক্ষক, দু-একজন হয়তো সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এনসিটিবির এক সভায় মন্ত্রণালয় থেকে আগত একজন অতিরিক্ত সচিব বলেছিলেন, ‘আপনারা সব বিশেষজ্ঞ হয়ে বসে আছেন। জীবনে কেউ কোনো দিন একটি রচনাও নিজ থেকে লিখেছেন, লেখেননি, সবাই বিশেষজ্ঞ। যারই ঢাকায় বদলি হওয়া দরকার, লবিং করে, লোক ধরাধরি করে, ঢাকায় এসে এনসিটিবিতে পোস্টিং নেন। এনসিটিবি হচ্ছে একটি গারবেজ।’ এ কথাগুলোর উত্তর দেখলাম কোনো এনসিটিবি কর্মকর্তা ওইদিন দিতে পারেননি অর্থাৎ কথাগুলো সত্য।

২০১২ সালের কারিকুলাম প্রণয়নের পর শিক্ষার আরেকটি প্রকল্প ‘সেসিপের’ মাধ্যমে ২০১৭ সালে এটি রিভিউ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের অর্থ ছাড়ে দেরি হওয়ায় সেই রিভিই আর হয়নি। এরপর ঠিক হয় ২০১২ সালের কারিকুলাম রিভিউয়ের কাজটি করবে শিক্ষার আরেক প্রকল্প ‘এসইডিপি’। এসইডিপি রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নিলে সেসিপ কাজটি আর করেনি। ২০১৯ সালে এসে এনসিটিবি জানায়, এসইডিপি নয়, এনসিটিবি নিজেরাই রিভিউয়ের কাজটি করবে।

প্রশ্ন হচ্ছে রিভিউ করার জন্য এনসিটিবির কি সেই লোকবল, সেই দক্ষতাসম্পন্ন লোকজন আছে? কর্মকর্তা যে কজন আছেন, তারা সবাই টেন্ডার ডাকা, বই ছাপা আর বই বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কারিকুলাম রিভিইউ করার মতো কজন সেখানে আছেন? বিনামূল্যে বই বিতরণ করা সরকারের একটি সিদ্ধান্ত, কিন্তু এই বই কোনো বছরই যে শিক্ষার্থীরা সময়মতো পায় না; সেটির খবর আর কে রাখেন! বেসরকারি পর্যায়েই বেশি শিক্ষক, বেশি শিক্ষার্থী। তাদের বিনামূল্যের এই বই নিতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত, পদে পদে ঘুষ দিতে হচ্ছে; তা কি কর্র্তাব্যক্তিরা খোঁজ রাখেন, নাকি ইচ্ছে করেই তাদের জন্য ব্যবস্থাটি করে রেখেছেন, বুঝতে কষ্ট হয়। কোনো বিদ্যালয়ে বই বিতরণ করার পর আবার কিছু বই হাতে রেখে দেন, যাতে কদিন পরে আর একটি টাকার খাম হাতে পান। এই বাস্তবতার সঙ্গে এনসিটিবি, মাউশি কিংবা মন্ত্রণালয়ে কজন পরিচিত জানি না, কিন্তু ঘটনা সত্য।

আমাদের দেশে যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয়, তা সবারই জানা। নিয়োগের পর কজন পড়াশোনা করেন! অনেকেই শিক্ষক রাজনীতিসহ অন্য সব বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কেউ কেউ নিজের একটি বিষয় বা চ্যাপ্টার ছাড়া তার বাইরে সারা জীবনে কিছু পড়াতে যান না। অনেকে দেশের শিক্ষা সম্পর্কেই পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নন। এ আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর নাকি গবেষণা করছেন কিংবা একটি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছেন। তার কয়েকটি প্রশ্ন আমাকে অবাক করেছে। (ক) বাংলাদেশে কি কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে (২) বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা তো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, তাই না? আমি বললাম ‘না’। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। উনি তখন বললেন, আপনি কি শিওর। (৩) প্রাথমিক শিক্ষকরা কি তাহলে এমপিও পায় ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও সবাই এমন নন। অনেকেই দেশের পুরোপুরি শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক ভালো জানেন। তাদের সংখ্যা অবশ্য খুবই কম।

এনসিটিবি কিছু এনজিওকে সংযুক্ত করেছে কারিকুলাম প্রণয়নের কাজে। বিষয়টি প্রায়ই পত্রিকায় আসছে এমনভাবে যে, এনজিওর কারিকুলাম নিয়ে কোনো ধারণা নেই, তারা কারিকুলামের কী বুঝে? এখানে কয়েকটি বিষয় জড়িত। একটি হচ্ছে যেসব এনজিও শিক্ষা নিয়ে কাজ করে, তারা শিক্ষার খুঁটিনাটি, দেশের, গ্রামের, সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা সরাসরি জানে এবং প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে। যা কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী, বিদেশি কোনো কনসালট্যান্টের দ্বারা সম্ভব নয়। গ্রামের অসহায় মানুষ, শহরের বস্তিবাসীদের জন্য শিক্ষা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে, সেটি সরকারের কোনো সংস্থার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আমি নিজে বহু বছর যাবত প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু অনেকেই স্বীকারও করবেন না, না করারই কথা। তবে এটি সত্য। এ ধরনের কাজ কিন্তু সব এনজিও করে না, করতে পারেও না। তাদের যদি দেশের কারিকুলাম তৈরির কাজ দেওয়া হয়, সেটি মেনে নেওয়া যায় না। যে দুটো এনজিওর নাম দেখলাম তাদের জাতীয় কারিকুলাম তৈরির অভিজ্ঞতা, দক্ষতা কোনোটিই নেই। যেমন প্ল্যান বাংলাদেশ, টিকট্যালিক এ ধরনের এনজিওকে যদি কারিকুলাম তৈরির কাজ দেওয়া হয়, তাহলে তো তা হবে হাস্যকর। ব্র্যাকের মতো আন্তর্জাতিক এনজিও যার শিক্ষা মডেল শুধু বাংলাদেশে নয়, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশে চালু করার জন্য জাতিসংঘ থেকেই বলা হয়েছে এবং সফলভাবে এসব দেশে ব্র্যাকের ‘কোর্ট মডেল’, এক্সিলারেটেড মডেল চালু আছে। ব্র্যাককে এখানে রাখা হয়নি। তার পরও বলব, শুধু এনজিওদের দিয়ে বা তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি দেশের কারিকুলাম তৈরি করা ঠিক নয়।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদকে সচিব মর্যাদার করা এবং এটিকে পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসান প্রদান করা উচিত; যাতে তারা কারিকুলাম তৈরি ও রিভিউয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও পান্ডিত্যপূর্ণ কাজ অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে করতে পারে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর সব সিদ্ধান্তের জন্য বসে থাকতে না হয়। এটি করা উচিত। কিন্তু সেক্ষেত্রে এনসিটিবি চেয়ারম্যানকে সেভাবেই নিয়োগ দিতে হবে। যাকে তাকে ধরে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এত বিশাল এবং মহান দায়িত্ব দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। রাজনীতি আপনারা করেন, কিন্তু সব জায়গায় নয়। উদাহরণস্বরূপ বলছি, এনসিটিবির চেয়ারম্যান হতে হবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, জাফর ইকবাল স্যারদের মতো ব্যক্তিত্ব। জানি এ ধরনের ব্যক্তিত্ব তৈরি করা বা হওয়া এ সমাজে সহজ নয়, কিন্তু করতে হবে। প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও দেশকে এ ধরনের শিক্ষাবিদ তৈরি করতে হবে। হঠাৎ কোনো এক কলেজ সরকারি হয়েছে কিংবা যার একটু ধরা করা বেশি তাকে ধরে এন এনসিটিবির চেয়ারম্যান বানানোর মতো ট্রাডিশন থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বেরিয়ে আসতে হবে।

এখন সমস্যাটা হচ্ছে, যাদের এখানে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তা না করে, অত্যন্ত পণ্ডিত ব্যক্তিকে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বানানো প্রয়োজন। বর্তমানে যেটি হচ্ছে, ইংরেজি কারিকুলাম সমন্বয়ের দায়িত্বে আছেন প্রাণিবিজ্ঞান থেকে পড়াশোনা করে আসা একজন কর্মকর্তা। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এসব কর্মকর্তা রাখা হয়নি। বাদ দেওয়া হয়েছে কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট উইংকেও। আবার অখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রাখা হয়েছে শিক্ষাক্রম প্রণয়নে। ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা শিক্ষকও রাখা হয়েছে। তাই বলছি, শিক্ষাজগতে যারা বিশাল ব্যক্তিত্ব তাদের এনসিটিবির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করতে হবে। তারা ব্যক্তিগত পছন্দের লোক নিয়োগ করলেও তাদের মতো পড়াশোনা জানা লোক নিয়োগ দেবেন। আর এনসিটিবির চেয়ারম্যান একটি চাকরির মতো দেখলে হবে না যে, তিন বছর বা চার বছর বা দুই টার্ম চেয়ারম্যান পদে থাকবেন। এই পদ হতে হবে ১০ থেকে ১২ বছরের, যাতে একটি কারিকুলাম প্রণয়ন করার পর তার পাইলটিং, ইফেক্ট সবই একজন চেয়ারম্যান দেখে যেতে পারেন।

লেখক : শিক্ষাবিশেষজ্ঞ ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close