ডা. গোলাম শওকত হোসেন

  ২৪ নভেম্বর, ২০২১

মুক্তমত

ঘরে ঘরে প্রজ্বালিত হোক উদারতার প্রদীপ

ওয়ার্ল্ড কাইন্ডনেস মুভমেন্টের অর্থ হলো, ‘বিশ্ব সহৃদয়তা আন্দোলন’। সামাজিক, ধর্মীয় ও মানবিক দর্শনের প্রেক্ষাপটে কাইন্ডনেস হলো মানুষের মনের উদারতা বা সহৃদয়তা, যা মানুষকে অন্তর থেকে তাড়িত করে বিনা প্রতিদানের আশায় মানুষের উপকার করার লক্ষ্যে। অতএব, ‘ওয়ার্ল্ড কাইন্ডনেস মুভমেন্ট’কে বাংলায় ‘বিশ্ব উদারতার পথযাত্রা’ বলাই শ্রেয়। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলও কাইন্ডনেসকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেন মানুষের বেলায়। এই উদারতার ইতিহাস গৌতম বুদ্ধ থেকে যিশুখ্রিস্ট এবং মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনীতেও উজ্জ্বলভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছিল বারবার। আবার কালের বিবর্তনকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্পার্টাকাস থেকে লেনিন পর্যন্ত বিপ্লবের বিজয়ী মশাল বা সক্রেটিস থেকে সার্ত্রে পর্যন্ত জ্ঞানের প্রজ্বালিত শিখার মাঝেও নিহিত ছিল মানুষের জন্য সহৃদয়তা, উদারতা বা ক্ষমা। নেলসন ম্যান্ডেলা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অত্যাচারীদের, এমনকি তার ছেলের হত্যাকাণ্ডে মূল ষড়যন্ত্রকারী এবং কয়েদি অবস্থায় তার প্রধান পাহারাদানকারী অফিসার জেমস গ্রেগরিকেও ক্ষমা করেছিলেন সহৃদয়তার বদান্যতায়।

সভ্যতার শুরু থেকে উদারতার বিনিসুতার মালার মধ্য দিয়েই পরিবার, দল, গোত্র ও এমনকি জাতির জন্ম হয়েছে। উদারতার তাড়নায় মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, একে অপরের দুঃখ লাঘবের জন্য সচেষ্ট হয়েছে, নতুন কিছু আবিষ্কারের মাধ্যমে মানবসমাজের উপকার করেছে। পক্ষান্তরে এটাও উপলব্ধি করেছে, মানুষ যেহেতু জন্মগতভাবে আত্মকেন্দ্রিক, সেহেতু উদারতার মালা দিয়েই কেবল এই স্বার্থপরতার প্রাচীরকে ভাঙা সম্ভব।

মহাকালের স্রোতে ভাসতে ভাসতে স্বার্থান্বেষী মানুষ বিভক্ত হয়েছে অসংখ্য জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম বা দেশে; লিপ্ত হয়েছে হাজারো মতানৈক্যে, যুদ্ধে। কিন্তু দিনশেষে এটাও উপলব্ধি করতে শিখেছে, বিভাজন চিরস্থায়ী সমাধান না। কারণ হৃদয়ের উদারতার তাড়না সেই যুদ্ধরত মানুষই একে অন্যের ব্যথাকে অনুধাবন করতে শিখিয়েছে। সেই যুদ্ধরত মানুষ আবার শত্রুকে বুকে টেনে নিয়েছে, সাহায্য করেছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তৈরি হয়েছে এসওএস, সেলভ্যাসন আর্মি, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউনাইটেড নেশন, রেড ক্রস, স্কাউটিং, লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি। সবই হয়েছে মানুষের উদারতার টানে।

কিন্তু কোটি কোটি মানুষের অসুখ-বিসুখ, দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন ইত্যাদিকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাধান করা সম্ভব না। মানুষের অগণিত সমস্যাকে পুরোপুরি সমাধান দিতে না পারলেও খণ্ড খণ্ডভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে উদার মানসিকতা নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেও তা অনেকাংশে লাঘব হবে। অন্তত প্রতিটি সমস্যা জর্জরিত মানুষ তার মানসিক হাহাকার কমানোর মাধ্যমে কোমর শক্ত করে দাঁড়াতে পারবে।

উদারতার পথযাত্রা শুধু ওষুধ বা অর্থদানের মধ্য দিয়ে হয় না; বিপদে সাহস, দুঃসময়ে আশ্রয়, ক্ষুধার্ত অবস্থায় সামান্য খাবার, বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দেওয়া, রোগীকে দুদণ্ড হাসিয়ে শান্তি দেওয়া, অন্ধকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করা, মানুষকে শিক্ষার আলোতে আনা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া অথবা সুচিন্তিত বুদ্ধি বা কারিগরি বুদ্ধিদান করেও তা হতে পারে- শুধু প্রয়োজন উদার প্রাণের প্রসারিত হাত।

১৯৯৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাপানের টোকিওতে ‘ওয়ার্ল্ড কাইন্ডনেস মুভমেন্ট’-এর জন্ম হয় পৃথিবীর ২৭টি দেশের পরোপকারী প্রতিনিধির উপস্থিতিতে। যেখানে ধার্য করা হয়, ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতি বছর ১৩ নভেম্বর ‘ওয়ার্ল্ড কাইন্ডনেস ডে’ বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় উদারতার সঙ্গে মানুষের সাহায্যের হাতকে প্রসারিত করে অনুপ্রেরণার জন্য। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরি করাই এর মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে এই আন্দোলনের মশালবাহী সংস্থা হলো ‘সম্মান ফাউন্ডেশন’। পৃথিবীর প্রতিটি সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে অসহায়, পীড়িত বা দুস্থ ব্যক্তির প্রতি সদয় হওয়ার জন্যই এই প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টার সূতিকাগার যদি প্রতিটি অবস্থাপন্ন পরিবারে হয়, তাহলে তা নীরবে অথচ দ্রুতগতিতে তার লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবে। কারণ প্রতিটি অবস্থাপন্ন বাড়ি বা পরিবার ঘিরে অন্তত গড়ে তিনটি লোক এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে।

বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিল্পকর্মে নিয়োজিত প্রায় ৪০ লাখ নারীকর্মী, যারা সরকারিভাবে শ্রমিক হিসেবে অন্তত স্বীকৃত এবং বাস্তবেও বেশকিছু সুবিধাভোগী। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায় দুই কোটি নারী গৃহকর্মী বর্তমানে কর্মরত। পাঁচ থেকে ছয় বছর আগেও তারা সরকারিভাবে শ্রমিক হিসেবে অন্তত কাগজে-কলমেও স্বীকৃতি পায়নি; বর্তমানে পেলেও তার কার্যকরী কোনো স্বীকৃতি নেই সমাজে। সম্মান ফাউন্ডেশনের আন্দোলনের ফলে তারা শ্রমিক হিসেবে অন্তত কাগজে-কলমে স্বীকৃতি পেয়েছে। সম্মান ফাউন্ডেশনের মতে, উদ্যোগ ঘর থেকেই শুরু হওয়া উচিত। গৃহকর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সাক্ষরতা জ্ঞানার্জন ও সভ্যতার প্রাথমিক জ্ঞানার্জনের দায়িত্ব গৃহকর্তারই। যদিও আমাদের অনেকে আজও তাদের চাকর, চাকরানি অথবা ইংরেজিতে ঔপনিবেশিকভাবে এমএলএসএস বলে। তারা আসলে কূপমণ্ডুক, আন্তর্জাতিকভাবে তাদের বলা হয়, সহায়তাকর্মী বা ইংরেজিতে বলে হেল্পিং হ্যান্ডস বা সাপোর্ট স্টাফস। সম্মান ফাউন্ডেশন বর্তমানে অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজের পাশাপাশি গৃহকর্মীদের কল্যাণকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। গৃহকর্মীরা ভালো থাকলে অথবা সুস্থ, অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ও সময়োপযোগী ন্যূনতম পৌরজ্ঞানসম্পন্ন হলে গৃহকর্তা এবং তার পরিবার ভালো থাকবে। তার সবচেয়ে বড় সাফল্য আমরা দেখেছি এই করোনাকালে সব শ্রেণির মানুষের সামাজিক সচেতনার মাধ্যমে। আর এই দুই কোটি মানুষকে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে উন্নত করতে পারলে আমাদের দেশের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সেরও মানোন্নয়ন ঘটবে। সম্মান ফাউন্ডেশনের পথযাত্রা সফল হোক। আর কামনা করি, ঘরে ঘরে এই উদারতার মঙ্গলদীপ প্রজ্বালিত হয়ে তা জোনাকির আলোর মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুক।

লেখক : চিকিৎসক ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close