reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৮ অক্টোবর, ২০১৬

অভিমত

কবির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর উদারতা

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

মানুষ পৃথিবীতে আসে তার মুক্ত চিন্তাধারাকে বিকশিত করতে। তবে সবাই তার সৃষ্টিশীলতার আলোকবর্তিকা দিয়ে জনমানুষের ভাবনার ভেতরে প্রবেশ করে সুপ্ত সত্তাকে জাগ্রত করতে পারে না। এটা কেবল পারে মুক্ত বিহঙ্গের মতো একজন আলোকিত বাস্তববাদী ও স্বপ্নমুখী মানুষ। তিনিই কবি। যিনি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান। যিনি জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করেন এবং মানুষের মধ্যে বাস্তবতার উন্মেষ ঘটান। সমাজ, মানুষ ও প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে তারা দেখেন ও বিশ্লেষণ করেন। এভাবে মানুষকে তারা ভাবতে শেখান। তাই একজন কবিকে যখন আরেকজন বিখ্যাত মানুষ বিন¤্র শ্রদ্ধায় গ্রহণ করেন, তখন সৃষ্টি হয় এক অন্যন্য ইতিহাস। সব বিখ্যাত মানুষের মধ্যেই কবির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বিষয়টি কাজ করে না। এটা কাজ করে কেবল তাদের মধ্যে যারা উদার সংস্কৃতির মনোভাব হৃদয়ে লালন ও ধারণ করেন। কেননা কবির দৃষ্টিভঙ্গি তাদের কাজের ক্ষেত্রকে বিকশিত করে।

আমরা এই সৃজনশীলতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করতে দেখেছিলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মানসপটে। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাংস্কৃতিক মনোভাবকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই কবির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে তিনি আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মূল চরণগুলো কবিগুরুর লেখা গান থেকে নিয়েছিলেন। এখানে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ কবির এই কিংবদন্তি পঙক্তিমালা বঙ্গবন্ধুকে সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে প্রত্যয়ী করেছিল। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘এই সঞ্চয়িতা সঙ্গে থাকলে আমি আর কিছুই চাই না। নাটক নয়, উপন্যাস নয়, কবিগুরুর গান ও কবিতাই আমার বেশি প্রিয়। সব মিলিয়ে এগারো বছর কাটিয়েছি জেলে। আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল এই সঞ্চয়িতা। কবিতার পর কবিতা পড়তাম আর মুখস্থ করতাম। এখনো ভুলে যাইনি। এই প্রথম মিয়ানওয়ালি জেলের নয় মাস সঞ্চয়িতা সঙ্গে ছিল না। বড় কষ্ট পেয়েছি। আমার একটি প্রিয় গানকেইÑ‘আমার সোনার বাংলা’ আমি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত করেছি।’ ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে কবিগুরুর এই গানটির প্রথম দশ লাইন নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত হয়। যা আজ প্রতিটি বাঙালির গৌরবের বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

জ্যৈষ্ঠের খরপ্রহরে শান্তি নিকেতনের শ্যামলীতে বসে গভীর আগ্রহের সঙ্গে কবিগুরু পড়ছিলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আত্মজীবনী গ্রন্থ। ১৯৩৬ সালের ৩১ মে এ প্রসঙ্গে কবিগুরু লিখলেন ‘এই মাত্র আমি তোমার মহাগ্রন্থ পড়া শেষ করেছি। তোমার এই কীর্তির দ্বারা আমি গভীরভাবে প্রভাবিত ও গৌরবান্বিত। গ্রন্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের মধ্য দিয়ে মনুষ্য জাতির এমন এক নিগূঢ় ধারা প্রবাহিত, যা সত্যের জটিলতা অতিক্রম করে সেই ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাবার জন্য যিনি তাঁর কীর্তির চেয়ে মহৎ এবং পরিবেষ্টনের চেয়ে সত্য। তোমার একান্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের এই পত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে জওহরলাল নেহরু লিখলেন, ‘অনেক বন্ধু আমার বইয়ের প্রশংসা করেছেন। কেউবা আমার সমালোচনাও করেছেন। কিন্তু আপনার প্রশংসাবাণী আমাকে আনন্দিত ও শক্তিশালী করেছে। আপনার আশীর্বাদ পেলে আমি বোধহয় এক বিরুদ্ধ পৃথিবীর সামনে দাঁড়াতে পারি।’ এখানে কবি যেমন জওহরলাল নেহরুর প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তেমনি জওহরলাল নেহরুর মতো বিখ্যাত একজন রাজনৈতিক নেতা কবির প্রতি তার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কারণ কবির দেশকে নিয়ে চিন্তা ও ভাবনা নেহরুর মতো একজন মানুষকে আধুনিক ভারত গড়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল। ছবি কথা বলে ইতিহাসের পাতা থেকে। একটি ছবিতে দেখা যায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বিন¤্র আনুগত্যের সঙ্গে বসে আছেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এটি ছিল কবির প্রতি একজন সৃষ্টিশীল মানুষের উদারতা ও মহানুভবতার প্রতীক। গান্ধীজী ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ। গান্ধীজীকে উদ্দেশ করে কবিগুরু বলেছিলেন, ‘যাহা কিছু মহৎ, যাহা কিছু সৎ মহাত্মাজী তাহারই প্রতীক। তিনি ভারতের প্রাণ স্বরূপ।’ আবার গান্ধীজী গভীর শ্রদ্ধায় রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বলে সম্বোধন করতেন। গান্ধীজীর চেয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আট বছরের বড়। কবিগুরুর আদর্শকে ধারণ করেছিলেন গান্ধীজী তার জীবনে ও মননে। মিল অমিলের মধ্য দিয়ে কবিগুরুর প্রতি গান্ধীজীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অকৃত্রিম বন্ধন অটুট ছিল। ইতিহাসের পাতা থেকে কবিগুরুর সঙ্গে গান্ধীজীর ছবিগুলো দেখলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। এটি ছিল কবি ও কবির জীবনদর্শনের প্রতি একজন গান্ধীজীর মতো মানুষের গভীর সম্পর্কের প্রতীক।

সংস্কৃতির এই আবহমান ধারা সাম্প্রতিককালে আবারো প্রতীয়মান হয়ে উঠল। একজন কবি হতে পারে জাতির বিবেকের দর্পণ। এই সংস্কৃতির দর্পণ মানুষকে সৃজনশীল করে তোলে। উদারভাবে দেশ, মানুষ ও প্রকৃতিকে নিয়ে ভাবতে শেখায়। তবে আজকের দিনে বড় নেতারা কবিদের উপলব্ধি ও দর্শন মেনে নিতে চান না। কবিদের প্রতি বড় বড় মানুষের অবজ্ঞা ও অবহেলা আজকের জীবনের চালচিত্র। সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী থেকে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটি যেন আজ বিসর্জিত। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে জীবনে ধারণ করেন। কবির কবিতা যে জাতির পরিবর্তনের দর্শন হতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমাদের প্রধানমন্ত্রী। ফলে বঙ্গবন্ধু, নেহরু, গান্ধীজীসহ বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতারা কবির প্রতি তাদের ভালোবাসার যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পেলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও আন্তরিকতায়। সব কালের ছবিগুলোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল একটি মিল, একটি অর্জন, একটি গৌরব ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। এটি ছিল জননন্দিত বিশ্বনেত্রীর মহানুভবতা ও উদারতার প্রতীক। এই সব্যসাচী লেখক নাগরিক সংবর্ধনার মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘দেশরতœ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি ছিল একজন কবির প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের সর্বজনীন প্রকাশ। এখানে কবি আসলে ছিলেন দেশের সব মানুষের প্রতীক। আর তার ভরসাস্থল ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। না ফেরার দেশে চলে গেলেন কবি। এজন্য প্রধানমন্ত্রী তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করলেন। এটি ছিল একজন কবির মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতিকে মর্যাদা দেওয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত।

লেখক : রেজিস্ট্রার ও বিভাগীয় প্রধান যন্ত্রকৌশল বিভাগ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist