ফারিহা হোসেন

  ০৯ মার্চ, ২০২১

বিশ্লেষণ

নারী ও শিশুর প্রতি সদয় হন

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে শিশু ও নারী নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। বেড়েছে যৌন হয়রানি, খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনাও। সরকার নারী-শিশুর ওপর নির্যাতন বন্ধে কঠোর অবস্থানে। পাশাপাশি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে সম্প্রতি আইন প্রণয়ন করেছে। সামাজিক অস্থিরতা, বিকৃত মানসিকতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে বলে মনে করেন অপরাধবিজ্ঞানীরা। এটা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন, পাড়া-মহল্লায় কমিটি গঠন করে জনসচেতনতা সৃষ্টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব, প্রকাশ্যে হাট-বাজার ও লোকালয়ে মাইকিং, প্রচারমাধ্যমে এর কুফল ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নিয়মিত প্রচারণা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সদ্য সংঘটিত আলোচিত খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনার দ্রুত বিচারের উদ্যোগ নিলে সমাজে নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতনের মাত্রা কমে আসবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি নারী-শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আইন পাস করেছেন। এ বিষয়ে তিনি তার সরকারের ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত রেখে জাতির কিছুতেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই হচ্ছে নারী। শিশুর হারও প্রায় সমপরিমাণ। তাই নারী ও শিশুর জীবনকে ঝুঁকিতে রেখে, সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে উল্টো হুমকিতে পড়বে। নিশ্চয় এ ধরনের পরিস্থিতি কারো কাম্য নয়। তাই সরকার, সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধি, ছাত্র-শিক্ষক, যুবক-যুবতী, আলেম সমাজ, প্রচারমাধ্যমসহ সর্বস্তরের মানুষকে সোচ্চার হতে হবে এর বিরুদ্ধে। করোনাকালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। এর সঙ্গে বেড়েছে প্রতারণাসহ নানা ধরনের অপরাধ। সাইবার ক্রাইমও বেড়ে গেছে অধিক হারে। করোনায় শুধু স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তা নয়, শাশুড়ি বা পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যদের হাতেও তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি শ্বশুরবাড়িতে নারী সদস্যদের হাতেও তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। শিশুদের বিপজ্জনক কাজে লাগানো হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ১৭ লাখ শিশু, যাদের বেশির ভাগই ছেলে, জীবন-জীবিকার তাগিদে তাদের অনেকেই কোনো না কোনো কাজে যুক্ত। আবার অনেক মেয়েশিশু ঘরকন্যার কাজে নিয়োজিত। এসব কিশোরী মেয়েকে অনেক সময়ই সহিংসতার পাশাপাশি যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। বলাবাহুল্য এরা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারি বিশেষ করে নারীদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। নারীরা বৈষম্য ও পারিবারিক সহিংতার শিকার হচ্ছে। এ কারণে নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের কষ্টার্জিত অর্জন হুমকির মুখে।’ নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অসামান্য উন্নয়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের উন্নয়ন এজেন্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীদের বসিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বে দেশে নারী-পুরুষ সম-অধিকারভিত্তিক একটি সংবিধান নিশ্চিত করা হয়।’ এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামালের উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক, ‘আমাদের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের বিবেক। বিবেককে ছাপিয়ে যখন প্রবৃত্তি প্রভাব বিস্তার করে, তখন ভোগবাদী সত্তা আধিপত্য বিস্তার করে। ধর্ষণকারীরা শুধু নারী লোলুপ নয়। তাই যদি হতো তাহলে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হতো না। প্রথমত, বিকারগ্রস্ত পুরুষ তার অবদমিত কাম চরিতার্থ করতে চায়। দ্বিতীয়ত, নারীর প্রতি প্রভুত্ব বা ক্ষমতা দেখাতে চায়। তৃতীয়ত, নারীকে ভোগের বস্তু মনে করে।’ সামাজিক আন্দোলন ও এসব ঘটনার দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচারের মাধ্যমে এই ব্যাধি থেকে নারী ও শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার, তার সবটুকুই করছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের অপরাধে জড়িতদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে না, বরং আনা হচ্ছে বিচারের আওতায়। এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রণীত নীতি ও কর্মসূচি দেশের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। যেকোনো দেশের জন্য যেকোনো পরিপ্রেক্ষিত থেকেই নারী ও শিশুর সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজকের শিশু আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর মায়ের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলে সমাজ, সংসারের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। কারণ একজন আদর্শ মা পারেন একটি আদর্শ জাতি উপহার দিতে। নেপোলিয়ান বোনাপার্র্টও সেই কথাই বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, তাহলে আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে পারব।’ কাজেই নারী ও শিশুর জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আমরা শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা এবং নারীদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারব। অন্যদিকে তাদের মানবাধিকার ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জোরদার করা সম্ভব হবে। সরকার ইতোমধ্যেই একটি জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল অনুমোদন করেছে। এটি বিভিন্ন কর্মসূচিকে জীবন-চক্রভিত্তিক পরিকল্পনায় একীভূত করতে চায়। গুণগত অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবার আওতা বৃদ্ধির জন্য আরো বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা দরকার। সেবাদাতাদের দক্ষতা ও সামর্থ্য শক্তিশালী করা এবং ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকা এতিম ও অসহায় শিশুর জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার বিষয়ে আরো বেশিমাত্রায় মনোযোগ দেওয়া উচিত। জাতিসংঘ শিশু সনদের (সিআরসি) ২০১৫ সালের সমাপনী পর্যবেক্ষণে সরকার কর্তৃক শিশুবান্ধব বাজেট প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে প্রশংসা করা হয়েছে।

তাদের সুপারিশে দেশের সব সামাজিক খাতে, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর জন্য বাজেট বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। শিশুবান্ধব বাজেটে অবশ্যই অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকবে। শিশুর জন্য ভালো বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে উন্নত রাজস্ব ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে বাংলাদেশকে আরো কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে বাল্যবিয়ে, যৌতুক বন্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার। পরিসংখ্যান বলছে, যৌতুক ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ১১,৬৩৬টি উঠান বৈঠক আয়োজন এবং ৬৪ জেলায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মনিটরিং কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর তাৎক্ষণিক সহায়তায় ‘জয়’ মোবাইল অ্যাপস চালু করা হয়েছে। ৬৭টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল এবং ৯টি ক্রাইসিস সেন্টার হতে ৩৫,৫২১ জন নির্যাতিত নারী ও শিশুকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হয়। ৪৭টি সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল হতে ৪৭,৫৫৮ জন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পেয়েছে। ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সিলিং সেন্টার হতে ২০০০ জন নারী ও শিশুকে মনোসামাজিক কাউন্সিলিং প্রদান; নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন ১০৯-এর মাধ্যমে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও বাল্যবিয়ে বন্ধে ১২ লাখ ৯৫ হাজার ৬৩৯টি ফোনকল গ্রহণ, কক্সবাজারের উখিয়ায় রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সিলিং সেন্টার স্থাপন, উখিয়ায় ৩৩ হাজার ৮৩৭ জনকে এবং সারা দেশে ৩৪ হাজার ৬৭৮ জন নারী ও শিশুকে মনোসামাজিক কাউন্সিলিং সেবা প্রদান করা হয়েছে।

আইনগত সহায়তার আওতায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের মাধ্যমে নির্যাতিতা, দুস্থ ও অসহায় ৩ হাজার মহিলাকে আইনগত পরামর্শ প্রদান; জেলা লিগ্যাল এইড কমিটিতে ৩২৩টি অভিযোগ প্রেরণ করাসহ মোহরানা ও খোরপোশ বাবদ ৩৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা আদায় করা; ২০১১ সালে গাজীপুরে ১০০ আসন বিশিষ্ট মহিলা, শিশু ও কিশোরীর হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের প্রতিটিতে ১০০ আসনবিশিষ্ট নারী সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অনুরূপভাবে নারী ও শিশুর জন্য চিকিৎসা সহায়তা কর্মসূচির আওতায় মহিলা ও শিশু ডায়াবেটিস এন্ডোক্রিন ও মেটাবলিক হাসপাতাল স্থাপন, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে শিশু ও মহিলা কার্ডিয়াক ইউনিট স্থাপন; ৫০ শয্যাবিশিষ্ট মহিলা ও শিশু ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রিন ও মেটাবলিক হাসপাতাল স্থাপন এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে নার্সেস হোস্টেল স্থাপন করা হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকার গৃহীত বিভিন্ন কর্মকান্ডের তথ্য তুলে ধরেছেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। নারীর সুরক্ষায় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের নেওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। নারী উন্নয়ন ও সমতার লক্ষ্যে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন ও দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্রের আলোকে নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নে উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রত্যাশা থাকবে নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের প্রতি সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ কখনো ধর্ষণকারী হয়ে উঠবে না। শিশুর কাছ থেকে স্মার্টফোন দূরে রাখতে হবে। স্মার্টফোনের নাগাল পেলেই তাদের জন্য পর্নোসাইটগুলোয় বিচরণের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। শিশু বয়সে এ ধরনের সাইট তাদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। এ ব্যাপারে অভিভাবকদেরও সচেতনতা দরকার। তাহলে সমাজ থেকে নারী-শিশুর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close