reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৯ অক্টোবর, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কষ্ট সাধারণ মানুষের

মো. মাঈন উদ্দিন

দেশে কয়েক মাসে করোনার প্রভাবে লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ সঞ্চয়ের শেষ অংশটুকুও আজ হারিয়ে পথে বসেছে। তিমির রাত্রিতে হাতড়িয়ে পথ খোঁজা এসব মানুষ আজ দিশাহারা। সহায়-সম্বলহারা এসব মানুষের এখন নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এমন ক্রান্তিকালে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে বাজারদর। সব জিনিসেরই দাম আকাশচুম্বী। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দর শুনে, দাম গুনে সাধারণ মানুষ ঘামছে দরদর করে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে। তাদের দীর্ঘশ্বাসের আদ্রতায় বাতাস ভারও বেড়ে যাচ্ছে।

বাজারে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম লাগামহীন। এসবের বাইরে এবার যোগ হয়েছে আলু। সঙ্গে ভোজ্যতেল, ডিম, আদা, রসুন ও সবজির উচ্চ দামও মানুষকে ভোগাচ্ছে। বাজারে ৫০ টাকা কেজির নিচে সবজি নেই বললেই চলে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির পদতলে জনজীবন পিষ্ট হয়ে পড়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সাধারণ মানুষের যেন ভোগান্তির শেষ নেই। বিভিন্ন পত্রিকার তথ্যমতে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮-৫০ টাকায়, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪২-৪৪ টাকায়। প্রতি কেজি মসুর ডাল (বড় দানা) বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৭৮ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৬৮-৭০ টাকা। খোলা আটা প্রতি কেজি ৩০-৩২ টাকা, এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ২৫-২৬ টাকা। ভোজ্যতেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ৮৬-৮৭ টাকা, এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৭৯-৮২ টাকায়। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৫১০ টাকা, এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকায়।

বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সবজি। কিছু সবজির কেজি ১০০ টাকা ছুঁয়েছে। আর কিছু সবজির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার কাছাকাছি। সবজির এমন চড়া বাজারে নতুন করে দাম বেড়েছে ডিম, আলু ও কাঁচামরিচের। এক সপ্তাহ আগে ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া আলুর দাম বেড়ে হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা। ১১০ থেকে টাকা ডজন বিক্রি হওয়া ডিমের দাম বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত চার মাসের বেশি সময় ধরে চড়া দামে বিক্রি হওয়া কাঁচামরিচের দাম নতুন করে আরো বেড়েছে। এক কেজি কাঁচামরিচ এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে হতাশ। তারা বলছে, প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। ফলে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে। আমাদের আয় সীমিত। এই আয়ে বাজার করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ভালো চাল কিনতে গেলে কেজিপ্রতি ৫২-৫৬ টাকা গুনতে হয়। পেঁয়াজের কেজি তো প্রায় ১০০ ছুঁই ছুঁই করছে। কাঁচামরিচের কেজি এখন ৩০০ টাকা। নিত্যপণ্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে এবার যোগ হয়েছে আলু। ৫৫ টাকার নিচে আলু নেই বাজারে। এ ছাড়া কোনো সবজির দামই অর্ধশতকের নিচে নয়।

এদিকে দাম বাড়ানোর পেছনে সেই আগের অজুহাত দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, তিন কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। এরমধ্যে রয়েছে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে পণ্যের উৎপাদন কমেছে। ইন্দো প্রদেশে পেঁয়াজের মোকামে শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং মাওয়া ঘাটে ফেরি পারাপার বন্ধের কারণে পণ্য ঢাকায় আসতে পারছে না। ফলে বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। খুচরা চাল বিক্রেতারা দুষছেন মিলারদের। তঁরা বলছেন, মিলারদের কারসাজিতে এখন পর্যন্ত চালের দর বাড়তি। তারা সিন্ডিকেট করে মিল পর্যায় থেকে সব ধরনের চালের দর বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে কারণে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে চালের দর বাড়তি। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, দেশে চাল, ডাল, তেল পেঁয়াজসহ সব পণ্যেরই মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনৈতিক লাভের নেশায় মেতে উঠেছেন। কেউ কেউ পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। এতে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কষ্ট বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের।

মন্ত্রণালয়ের সূত্র আরো জানায়, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর অবস্থানে সরকার। কোনো পরিস্থিতিতেই নিত্যপণ্যের বাজার যাতে অস্থির হতে না পারে; সেজন্য কৌশল নির্ধারণও করা হচ্ছে। পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার পাশাপাশি যাতে কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ ক্রেতার সাধ্যের মধ্যে রাখতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজন হলে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে মজুদ স্বাভাবিক রাখা হবে। যদিও পাইকারি ও খুচরা বাজারে আলু, পেঁয়াজ, চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর খুচরা ও পাইকারি বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের দাম কিছুতেই কমছে না। বরং বাড়ছেই।

হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই লাফিয়ে বাড়ছে আলুর দাম। মাসের ব্যবধানে আলুর দাম দ্বিগুণ বেড়ে এখন খুচরা বাজারে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পত্রিকার খরব থেকে জানতে পেরেছি, প্রতি কেজি আলুর দাম হিমাগারে ২৩ টাকা, পাইকারিতে ২৫ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৩০ টাকা দরে বিক্রি নিশ্চিত করতে সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদফতর। একই সঙ্গে উল্লিখিত দামে কোল্ডেস্টোরেজ, পাইকারি বিক্রেতা ও ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা বিক্রেতাসহ তিন পক্ষই যাতে আলু বিক্রি করেন; সেজন্য কঠোর মরিটরিং ও নজরদারির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে ডিসিদের কাছে পাঠানো হয়েছে চিঠি। চিঠিতে কৃষি বিপণন অধিদফতর জানায়, বাংলাদেশে গত আলুর মৌসুমে প্রায় ১ দশমিক ৯ কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। দেশে মোট আলুর চাহিদা প্রায় ৭৭ দশমিক ৯ লাখ টন। এতে দেখা যায়, গত বছর উৎপাদিত মোট আলু থেকে প্রায় ৩১ দশমিক ৯১ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকে। কিছু পরিমাণ আলু রফতানি হলেও ঘাটতির আশঙ্কা নেই। এ মৌসুমে একজন চাষির প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা। অথচ বর্তমানে বাজারে আলু খুচরায় প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এই যে বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি, এর পেছনে রয়েছে নানা কারণ। কারণ যাই হোক না কেন, সাধারণ মানুষের বাজার নিয়ন্ত্রণে কিছু করার নেই, কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া। বাজার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে, প্রশাসনকে। সঠিক পদক্ষেপ ও পরিকল্পনাতেই কেবল বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। বাজার দর নিয়ন্ত্রণে আসুক, নিম্ন আয়ের দীর্ঘশ্বাস কমে আসুক প্রত্যাশা এটাই।

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close