শফিকুল আলম

  ০৭ জুলাই, ২০২০

মুক্তমত

সবুজ অর্থায়ন আকর্ষণীয় করা কেন জরুরি

করোনাভাইরাস আমাদের জন্য অভাবনীয় দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে, যে কারণে স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্র সবকিছুই আজ অনেকটা হুমকির মুখে পড়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি অর্থনীতির চাকাকে সচল করা এবং মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর এ প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও জ্বালানি দক্ষতার ওপর নির্ভর করে সবুজ উন্নয়নের কথা ভাবছে।

পরিবর্তনের এ সুযোগে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মে মাসে উদ্যোক্তা, কল-কারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে সবুজ অর্থায়নে আগ্রহী করতে সবুজ পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনঃঅর্থায়নে বরাদ্দের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকা থেকে দ্বিগুণ করে ৪০০ কোটি টাকা, একক প্রতিষ্ঠানে ঋণসীমা বৃদ্ধি এবং আরো কিছু শর্ত শিথিল করেছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকার করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে বেগবান করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রণোদনা হিসেবে বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানাতে সরকারি ভর্তুকির কারণে যে সুদে চলতি মূলধনের জন্য ঋণ দেওয়া হচ্ছে, তা সবুজ অর্থায়নের সুদের হারের চেয়ে অনেক কম। দেশে এখন যেকোনো ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৯ শতাংশ। অর্থাৎ একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে প্রয়োজনে ৯ শতাংশের কম সুদেও ঋণ দিতে পারে। যেহেতু দেশে অনেকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালিত করছে, ভালো গ্রাহক পাওয়ার জন্য তাদের মাঝে বেশ প্রতিযোগিতা রয়েছে বলে শোনা যায়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভালো গ্রাহককে টানার জন্য ৯ শতাংশের বেশ কম সুদে ঋণ দিতে পারে, যাতে কোনো বাধা নেই। এমতাবস্থায়, সবুজ অর্থায়নের ৮ শতাংশ সুদের হারকে কোনোভাবেই আকর্ষণীয় বলা যায় না।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে, কোনো বিনিয়োগ কর্মসংস্থান তৈরিতে এবং টেকসই উন্নয়নে কতটা ভূমিকা রাখতে পারছে; সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, পিভি ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালে বিদ্যুৎ খাতে সারা বিশ্বে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ কাজ করবে, যে সংখ্যা ২০১৫ সালে ছিল দুই কোটি দশ লাখ। অন্যদিকে, এমনটি ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ খাতের ৮০ শতাংশ কাজের সুযোগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে তৈরি হবে।

কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে, জ্বালানি দক্ষতা খাতেও বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন বিশ্নেষণ অনুযায়ী, জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে এক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে যে কর্মসংস্থান হয়, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে সমান বিনিয়োগে প্রায় তিনগুণ সুযোগ তৈরি হয়। এ কারণে জ্বালানি দক্ষতা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উভয়েই জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের চেয়ে বেশি কাজের ক্ষেত্র করে দিতে পারে। অন্যান্য সবুজ শিল্পের কথা বিবেচনায় নিলে মোট কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা অনেক বেশি। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সবুজ অর্থায়নের আওতায় জ্বালানি দক্ষতা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ মোট ৫০টি পণ্যে ঋণ দেওয়ার অনুমোদন রয়েছে।

অন্যভাবে দেখলে, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে, কারখানার জ্বালানি খরচ কমে যাওয়ায়, বেঁচে যাওয়া অর্থ আলাদা খাত যেমন অন্য ছোট যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ কিংবা জনবলের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণে ব্যয় করা যেতে পারে। কাজেই করোনা পরিস্থিতিতে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি কারখানাগুলোকে বিশেষভাবে লাভবান করতে পারে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানি দক্ষতাতে বিনিয়োগ শুধু কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে তা কিন্তু নয়; সঙ্গে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে জলবায়ু পরিবর্তনের হারকে প্রশমিত করতে সহায়তা করে। স্থানীয় পরিবেশ সুরক্ষায়ও এর অবদান অপরিসীম।

জাতীয় নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২০-এর মধ্যে আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পূরণ করার কথা। করোনার প্রভাবে এবং নানাবিধ কারণে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একেবারেই অসম্ভব। আবার ২০২১ ও ২০৩০ সাল নাগাদ যথাক্রমে ১৫ ও ২০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে সরকার এরই মধ্যে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি ও জ্বালানি সংরক্ষণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সেসঙ্গে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসকল্পে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সমর্থনে, বাংলাদেশ সরকার যে কর্মপরিকল্পনা করেছে তাতেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি সম্পৃক্ত রয়েছে।

মোটকথা করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিকে গতিশীল করার পাশাপাশি আমাদের জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করতে হলে সবুজ অর্থায়নকে আরো আকর্ষণীয় করা উচিত, যাতে ব্যবসায়ী, কল-কারখানার মালিক এবং উদ্যোক্তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে কিংবা সবুজ কারখানা স্থাপন করতে বিনিয়োগে আগ্রহী হন।

উল্লেখ্য, সবুজ উন্নয়নে বিনিয়োগের প্রতিদান ও সহ-সুবিধা আমাদের সবুজ অর্থায়নকে আরো সময়োপযোগী করার দাবি জানায়। এ ক্ষেত্রে গতানুগতিক বিনিয়োগের প্রতিদান ও ক্ষতিকর প্রভাব যেমন পরিবেশ দূষণকে সবুজ বিনিয়োগের সুবিধা ও সহসুবিধার সঙ্গে তুলনা করলে সবুজ অর্থায়নের উপযোগিতা ও সবুজ অর্থায়নকে আকর্ষণীয় করার অত্যাবশ্যকীয়তা পরিষ্কার হয়। করোনার এ সময়ে, যেহেতু অনেক কিছু পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাবে, এটাই সুবর্ণ সময় কোনো আর্থিক উপকরণ নতুন করে ডিজাইন করার।

লেখক : প্রকৌশলী ও পরিবেশ অর্থনীতিবিদ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close