লায়ন মো. শামীম সিকদার

  ০২ আগস্ট, ২০১৯

স্বাস্থ্য

প্রান্তজনের কমিউনিটি ক্লিনিক

গর্ভবতী মায়েদের প্রসবপূর্ব ও পরবর্তী সেবা দেওয়া, শিশুর সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা শিক্ষা ও পরামর্শ প্রদানের লক্ষ্যে গ্রামীণ জনপদের পিছিয়ে পড়া লোকজনের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সাল থেকে হেলথ অ্যান্ড পপুলেশন সেক্টর প্রোগ্রামের অধীনে স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দিগন্ত হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেন। সেই থেকে অনেক ঝক্কিঝামেলা অতিক্রম করে আজ স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে সফল ও মডেল কর্মসূচি হিসবে পরিচিতি পেয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রান্ত জনগণের আস্থা অর্জন করে স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটিয়েছে এ ক্লিনিক। প্রত্যন্ত জনপদের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব মানুষ কমিউনিটি ক্লিনিককে স্বাস্থ্যসেবার আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করে। তারা যেকোনো অসুখে এখন প্রথমেই ঘরের পাশে কমিউনিটি ক্লিনিকে যাচ্ছেন। হয়তো সব রোগের চিকিৎসা না পেলেও পাচ্ছে সঠিক পরামর্শ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপন করা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এভাবেই সহজ করেছে চিকিৎসাসেবা ফলে বদলে দিয়েছে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার চিত্র। প্রান্তজনের স্বাস্থ্যসেবায় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার নিজের চিন্তাপ্রসূত কমিউনিটি ক্লিনিক এক যুগান্তকারী প্রবর্তন। তাই তিনি তার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিককে স্থান দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের সফল উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম কর্মসূচি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার আশার আলো কমিউনিটি ক্লিনিক। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিক বর্তমান সরকারে সাফল্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে; যা ইতোমধ্যে দেশে ও দেশের বাহিরে সুনাম অর্জন করেছে। অনেক দেশ তাদের জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটির ক্লিনিকের এই মডেল চালু করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তার ফসল কমিউনিটি ক্লিনিক। সরকারে একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মসূচি। ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে সরকার গঠনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প গ্রহণ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ২০০১ সালের মধ্যে ১০ হাজার ৭২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেন এবং ৮ হাজার ক্লিনিক চালু করেন। কিন্তু ২০০১ সালে পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প বন্ধ করে দেয় এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত এসব কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ ছিল। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প চালু করেন। এ সময়ে ৫ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ১৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার-সিএইচসিপি নিয়োগ দেওয়া হয় এবং বন্ধ ক্লিনিকগুলো চালু করা হয়। ক্লিনিকের ব্যবহার অযোগ্য ভবনগুলো মেরামত বা পুনর্নির্মাণ এবং নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক সারা দেশে পল্লী অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদান করে আসছে। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের লক্ষ্য অনুযায়ী আরো ১ হাজার ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ ও চালুর করার পরিকল্পনা আছে। ২০২২ সালের মধ্যে সারা দেশে ১৭ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ-সংক্রান্ত সরকারের ভিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর।

গ্রামীণ জনপদের প্রতি ৬ হাজার অধিবাসীর জন্য স্থাপন করা হয়েছে এক একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য স্থানীয় জনগণকে ৫ শতাংশ জমি কমিউনিটি ক্লিনিকের নামে দান করে দিতে হয়। সারা দেশে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ক্লিনিক থেকে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৫ কোটির বেশি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছে এবং এই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এক ব্যক্তির একাধিকবার সেবা গ্রহণের হিসেবে এ পর্যন্ত ৭৫ কোটিরও বেশি মানুষ কিমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা গ্রহণ করেছে। ৩ কোটি ৬৯ লাখের চেয়েও বেশি রোগীকে জরুরি ও জটিলতার জন্য উচ্চতর হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে ১ কোটি ক্লায়েন্ট কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা গ্রহণ করে থাকে। প্রত্যহ প্রতি ক্লিনিকে গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ জন মানুষ সেবা নিতে আসে। সেবাগ্রহীতার ৮০ শতাংশ নারী ও শিশু। দেশের প্রায় ৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারি করানোর সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত এসব ক্লিনিকে কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই প্রায় ৬০ হাজার নরমাল ডেলিভারি করানো হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে নিয়মিতভাবে ৩০ ধরনের ওষুধ রোগীদের মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। প্রতি বছর এ খাতে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা। কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা প্রদানের জন্য প্রতি ক্লিনিকে একজন করে কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার-সিএইচসিপি কাজ করছেন। সিএইচসিপিদের মধ্যে ৫৪ শতাংশই নারী সদস্য। সিএইচসিপিকে সপ্তাহে ৩ দিন সহযোগিতা করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারি স্বাস্থ্য মাঠকর্মী, স্বাস্থ্য সহকারী, ও পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীগণ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধনের মাধ্যমে তৃণমূলের জনগণের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা কার্যক্রমের সূচনা করেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তাপ্রসূত একটি যুগান্তকারী প্রবর্তন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই তৃণমূল মানুষের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প। কমিউনিটি ক্লিনিক বর্তমান সরকারের সাফল্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত; যা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে এবং অনেক দেশ তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার এ মডেল অনুকরণ করেছে। জনমুখী এ কার্যক্রম ১৯৯৬ সালে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে।

বিগত ১০ বছরে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ঈর্ষান্বিত ইতিবাচক উন্নতি অর্জন হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও তা প্রকাশ পেয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার কমেছে ২৯ শতাংশ। জন্মহার নেমে এসেছে ২.৩-এ। শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ৫৫ শতাংশে উন্নীত। মাতৃগর্ভে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা পাওয়া শিশুর সংখ্যা এখন ৬৪ শতাংশ, কম ওজনের শিশুর জন্মের হার নেমে এসেছে ৩৩ শতাংশে। সরকারের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা এবং পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি-এইচপিএনএসডিপির সুবাধেই স্বাস্থ্য খাতে এ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় দেশে ১৪ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। কর্মসূচির আওতায় সচেতনতামূলক পদক্ষেপের কারণে প্রসবকালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা নেওয়ার হার ৪২ শতাংশ, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের প্রবণতা ৬২ শতাংশ এবং হামের টিকা গ্রহণের প্রবণতা দাঁড়িয়েছে ৮৬ শতাংশে। ২৩ মাসের মধ্যে সবগুলো মৌলিক টিকা গ্রহণের হার এখন ৮৪ শতাংশ। এসব অগ্রগতিতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এমডিজির আওতায় ৫ বছরের কম বয়সি শিশু মত্যুহার কমিয়েই বাংলাদেশ ২০১০ সালে জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে নারী, শিশু ও দরিদ্রদের উন্নত মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এইচপিএনএসডিপি ভালো ভূমিকা রাখছে। এ প্রকল্পের আওতাধীন উপজেলা হাসপাতালগুলোতে নিশ্চিত ও নিরাপদ সেবা পাচ্ছেন গর্ভবতী মায়েরা।

কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পরিচালনার জন্য সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ১৩ থেকে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিউনিটি গ্রুপ আছে। এই গ্রুপের প্রধান থাকেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য। আর জমিদাতা থাকেন ভাইস চেয়ারম্যান। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ^ব্যাংক, জাইকা, ইউনিসেফ ইত্যাদি সংস্থা আর্থিক, কারিগরি ও লজিস্টিক সরবরাহের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিও কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মান উন্নয়নে কাজ করছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে যাতে কমিউনিটি ক্লিনিক সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে; সেজন্য মহান জাতীয় সংসদে কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্ট আইন-২০১৮ পাস হয়েছে। এতে ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনবলের বেতন-ভাতাদিসহ আর্থিক ব্যয়ভার নিশ্চিত করার জন্য অর্থ সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিক বর্তমান সরকারের একটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ উদ্যোগ। এ উদ্যোগের ফলে প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী বাড়ির পাশেই স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। দেশের সব কমিউনিটি ক্লিনিক যেন মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারে, এজন্য সরকার, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি গ্রুপ ও সাপোর্ট গ্রুপসহ সংশ্লিষ্ট সবাই আরো উদ্যোগী হতে হবে। সিএইচসিপিদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তদারকির মাত্রা আরো বাড়ালে ক্লিনিকের সেবার মান বৃদ্ধি পাবে। নিয়মিতভাবে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত হলে সেবাগ্রহীতার আস্থা আরো বাড়বে। সিএইচসিপিদের কাজের প্রতি আন্তরিকতা আরো বাড়াতে তাদের চাকরি জাতীয়করণের বিষয়টি সদয় বিবেচনার জন্য বিনীত আহ্বান রইল।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close