ইসমাইল মাহমুদ

  ৩১ জুলাই, ২০১৯

বিশ্লেষণ

বিলুপ্তির পথে রয়েল বেঙ্গল

আমাদের দেশে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যগুলো। প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য প্রজাতির পশু ও পাখি। আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এ পশুটি আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় ও ঐতিহ্যের স্মারক; আমাদের পরিচয়। ক্রিকেট মাঠে আমরা প্রায় সময়ই একটি প্ল্যাকার্ড দেখি ‘বাঘ আইল’। প্রতিপক্ষের প্রতি আমাদের এ একটি হুংকার। কিন্তু আজ থেকে ৫০ বছর পর হয়তো বাঘ আর এ দেশে দেখা যাবে না। আমাদের জাতীয় পশুটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে প্রকৃতি থেকে।

বিশ্বজুড়ে অসংখ্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে। ডাইনোসর নামক প্রাণীটির গল্প এখন বিজ্ঞানের গবেষণা ও কিংবদন্তির গল্পে সীমাবদ্ধ। অনেক আগেই এ প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে প্রকৃতি থেকে। কিছুদিন আগে ‘রিও’ নামক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘ব্লু’ নামক নীল রঙের ম্যাকাও পাখি এখন আর নেই। এটি আজ শুধু চলচ্চিত্রেই রয়েছে। এ দুটি প্রাণির মতো বাঘের ভাগ্যেও কি এ পরিণতিই রয়েছে? প্রকৃতি নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল আশাপ্রদ নয়। আবহাওয়ার পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন পরিবেশ দূষণজনিত কারণে বাসস্থান সংকটের কারণেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দ্রুত বিলুপ্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে অভিমত প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের। বাসস্থান সংকটের কারণে সম্ভাব্য বিলুপ্তপ্রায় পাঁচ লাখ প্র্রজাতির স্থলজপ্রাণীর মধ্যে বাংলার বাঘের নামটিও রয়েছে জাতিসংঘের প্রকাশিত তালিকায়।

বাংলাদেশ ও ভারত এ দুই দেশের প্রায় চার হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এ বনটি শত শত প্রজাতির প্রাণীর খাদ্য ও বাসস্থানের জোগান দেয়। বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ান ১০ জন বিজ্ঞানীর সম্পাদনা ও লেখায় প্রকাশিত একটি জার্নাল হলোÑ ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’। এ জার্নালে বলা হয়েছে, ‘সুন্দরবনের চার হাজার বর্গমাইলের প্রায় ৭০ ভাগ অংশ অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ৮০০ বর্গমাইল এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে মাত্র কয়েক ফুট ওপরে রয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতায় এ বনের রাজা ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ পুরোপুরি বিলুপ্ত হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। তারা ২০৭০ সাল নাগাদ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বাংলাদেশি অংশে কোনো রয়েল বেঙ্গল টাইগার জীবিত থাকবে না বলে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

সুন্দরবনের গত ১০ বছরের জোয়ার-ভাটার উচ্চতার মাত্রা নিয়ে গবেষণা করেছে একাধিক সংস্থা। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, জোয়ারের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি। গাঙ্গেয় ‘বদ্বীপ’ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে সৃষ্ট নদীমাতৃকতাই এই উচ্চতা বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে বলে গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে। ২০১০ সালে ‘ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’-এর প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ ইঞ্চির মতো বাড়লে কয়েক দশকের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা প্রায় ৯৬ শতাংশ কমে যাবে। এ ছাড়া বাঘ বিলুপ্তির জন্য বাঘের বাসস্থান সংকট ও অন্যান্য কারণ বের করেছেন শরীফ এ মুকুল ও তার সহকারী গবেষকেরা। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ থেকে ২০৭০ সালের মধ্যে বাঘের বাসস্থানের পরিমাণ ৫ দশমিক ৪ থেকে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১৯০০ সালে সুন্দরবনে মোট বাঘের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। সেসময় থেকে বাসস্থানের অভাব, শিকার ও অবৈধভাবে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ নিয়ে ঘটিত বাণিজ্যের কারণে এর সংখ্য ক্রমশ হ্রাস পেতে পেতে বর্তমানে মাত্র ৪ হাজারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ১১৮ বছরে বাঘ কমেছে ৯৬ হাজারের অধিক। আবহাওয়া পরিবর্তনের করণে বাঘের বাসস্থান ও খাদ্য ঘাটতির ফলে বাংলাদেশীয় সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আরো বেশি রয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। কারণ যত বাসস্থান ও খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে, ততই বাঘের বাসস্থান ও খাদ্যের সন্ধানে মানুষের বসবাসের এলাকায় বা লোকালয়ে চলে আসবে। তখন বাঘের উৎপাত বেড়ে যাবে লোকালয়ে। মানুষ নিজেদের রক্ষার লড়াইয়ে নামবে। যুদ্ধ হবে মানুষ-বাঘে। এতে করে মানুষের মধ্যে বাঘ শিকারের পরিমাণও অনেক বৃদ্ধি পাবে।

এদিকে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফার সুগত হাজরা সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার অভিমত, আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রাণীর বাসস্থানের অভাব হলেও বাঘের পরিণতি ততটা ভয়াবহ নাও হতে পারে। বাংলাদেশ বনবিভাগের সূত্রমতে, সুন্দরবনের অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমি ও বাঘের বাসস্থান সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ‘বেঙ্গল টাইগার কনজারভেশন অ্যাক্টিভিটি (বিএজিএইচ)’ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের বাঘ গণনা কার্যক্রম শেষে বাংলাদেশ বনবিভাগ জানিয়েছে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। গত তিন বছরে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে আটটি। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। আর ২০১৮ সালে ‘ক্যামেরা ট্যার্পিং’-এর মাধ্যমে বাঘ গণনার পরে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১১৪। ৯ মাস ধরে পরিচালিত এই জরিপে মোট চারটি ধাপে তিনটি ব্লকের (সাতক্ষীরা, খুলনা ও শরণখোলা রেঞ্জ) ১৬৫৬ কিলোমিটার এলাকায় ক্যামেরা বসিয়ে এই গণনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে ওই তিনটি ব্লকজুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশীয় সুন্দরবনে ৬৩টি পূর্ণবয়স্ক বাঘ, ৪টি জুভেনাইল বাঘ (১২-১৪ মাস বয়সি) এবং ৫টি বাচ্চা বাঘ (০-১২ মাস বয়সি) এর মোট ২৪৬৬টি ছবি পাওয়া গেছে। বর্তমানে এই প্রকল্পের অধীনে সুন্দরবন অঞ্চলে বাঘ সংক্রান্ত গবেষণা এবং বাঘ সংরক্ষণ ও এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চলছে।

বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বন। এই বন উজাড় হয়ে গেলে বাসস্থান ও খাদ্য উভয় প্রকার সংকটের কারণেই বাঘসহ অন্যান্য প্রাণী দ্রুত প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ বনাঞ্চল থেকে সরিয়ে অন্য কোনো স্থানে সংরক্ষণ করে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে প্রথমেই প্রয়োজন গণসচেতনতা। এ ছাড়া জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে বা ভীত হয়ে বাঘ বা অন্য কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নতুবা প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ধারণা মতে, ২০৭০ সালের পর বেঙ্গল টাইগার শুধু ছবি বা পুস্তকেই স্থান করে নেবে। জীবন্ত বা প্রকৃত বাঘ আর দেখা যাবে না। তাই বাঘকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করা প্রয়োজন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close