এস এম নাজের হোসাইন

  ২১ জুন, ২০১৯

পর্যালোচনা

নিষিদ্ধ ৫২ পণ্য ও হাইকোর্টের আদেশ

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) কর্তৃক পুনঃনিরীক্ষার নামে মানহীন নিষিদ্ধ ঘোষিত ৫২টি পণ্যের মধ্যে বেশ কিছু পণ্যকে পুনরায় মান উত্তীর্ণ বলে চালিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে অনভিপ্রেত, অনাকাক্সিক্ষত ও বিএসটিআইয়ের মান পরীক্ষণ সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টির অবকাশ বলে মন্তব্য করে পুনঃপরীক্ষণ হতে হলে তৃতীয় পক্ষের পরীক্ষাগারে হওয়া উচিত এবং সেখানে বিএসটিআই ও সংশ্লিষ্ট উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ভোক্তা প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাব ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি দরকার ছিল বলে মতপ্রকাশ করা হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে অনেকেই মনে করছেন, বিএসটিআইয়ের ৫২টি পণ্যের নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হাইকোর্টে আইনি লড়াইয়ে হেরে গিয়ে বিএসটিআইকে ম্যানেজ করে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে নিষিদ্ধ ঘোষণার ১৭ দিনের মাথায় ওয়েলফুড ও মধুবনের লাচ্ছা সেমাই, এসিআইয়ের লবণ, নিউজিল্যান্ড ডেইরির ডুডলস নুডলসসহ বেশ কিছু পণ্য বিএসটিআইয়ের পুনঃনিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো।

এটা প্রায়শ দেখা যায় ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হ্ইাকোর্টে আইনি লড়াইয়ে কোনো সুরাহা না পেয়ে চিরাচরিত প্রথায় বিএসটিআইকে ম্যানেজ করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জাতিকে লজ্জিত করেছে। কারণ বিএসটিআইয়ের মান সনদ প্রদানে অনিয়ম ও দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাহীন ভোগান্তি নিয়ে প্রতিনিয়তই সংবাদমাধ্যমগুলোয় নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতি ও অনিয়মে অকুণ্ঠ নিমজ্জিত এ প্রতিষ্ঠানকে সেখান থেকে বের করা যাচ্ছে না। সে কারণে একই পণ্য একবার নিরীক্ষণে মানহীন প্রমাণিত হয় আবার পুনঃনিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, বিষয়টি উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিজের মান সম্পর্কেই সাধারণ জনগণের সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। একই সঙ্গে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বাজার থেকে পণ্যগুলো তুলে না নিয়ে পুনঃনিরীক্ষণের নামে অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে নতুন ফন্দি করা হাইকোর্টের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শনের শামিল।

এদিকে নিম্নমানের পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ২৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এর মধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের। বিএসটিআইয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, খোলাবাজার থেকে সংগ্রহ করা ৪০৬টি নমুনা পরীক্ষায় ৫২টি নমুনার নিম্নমান পাওয়া যায়। নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছিল। নোটিসের সময়সীমা শেষ হওয়ায় ৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। লাইসেন্স বাতিল করা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑ আল সাফি ড্রিংকিং ওয়াটার, শাহারী অ্যান্ড ব্রাদার্স (পণ্য-নারজান ড্রিংকিং ওয়াটার), মর্ণ ডিউ পিওর ড্রিংকিং ওয়াটার, আর আর ডিউ ড্রিংকিং ওয়াটার, শান্ত ফুড প্রডাক্টস (পণ্য-টেস্টি, তানি ও তাসকিয়া), জাহাঙ্গীর ফুড প্রডাক্টস (প্রিয়া ব্র্যান্ডের সফট ড্রিংক পাউডার) ও বনলতা সুইটস অ্যান্ড বেকারি (বনলতা ব্র্যান্ডের ঘি)।

বিএসটিআই বলেছে, ২৭টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া সময় এখনো শেষ হয়নি। তাই তাদের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। লাইসেন্স স্থগিত হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সরিষার তেলে সিটি ওয়েল মিল, গাজীপুর (তীর); গ্রিন ব্লিসিং ভেজিটেবল ওয়েল, নারায়ণগঞ্জ (জিবি); শবনম ভেজিটেবল ওয়েল, নারায়ণগঞ্জ (পুষ্টি); বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল, নারায়ণগঞ্জ (রূপচাঁদা); সুপেয় পানির মধ্যে আররা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ (আররা); ডানকান প্রডাক্ট (ডানকান), দিঘি ড্রিংকিং ওয়াটার (দিঘি); প্রাণ এগ্রো লিমিটেডের প্রাণ ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই, হলুদের গুঁড়ার মধ্যে ড্যানিশ, প্রাণ ও ফ্রেশ। কারি পাউডারের মধ্যে প্রাণ ও ড্যানিশ; আয়োডিনযুক্ত লবণের মধ্যে এসিআই ও মোল্লা সল্ট; ধনিয়া গুঁড়ার মধ্যে এসিআই পিওর, নুডলসের মধ্যে নিউজিল্যান্ড ডেইরির ডুডলস এবং চিপসের মধ্যে কাশেম ফুডের সান ব্র্যান্ড। বিগত ১২ মে বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় নিম্নমান প্রমাণিত হওয়ায় ৫২টি খাদ্যপণ্য অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব খাদ্যপণ্য বিক্রি ও সরবরাহে জড়িত লোকজনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের প্রতি এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দেশে মান নিয়ন্ত্রণে জাতীয় মান প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। আর বিএসটিআই এর মান সনদ ছাড়া ১৫২টি খাদ্যপণ্য বাজারজাত করা সম্ভব নয়। তাই যারা মান সনদ দিবে তারাই মূলত এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। তার পরও দেখা গেছে, জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর অনেক জায়গায় জেলা প্রশাসন ও র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বাজার থেকে নি¤œমানের পণ্যগুলো সরিয়েছেন। অন্যদিকে হাইকোর্টের আদেশের ১৭ দিনের মাথায় আবার বিএসটিআইয়ের সঙ্গে যোগসাজশে অনেকে আবার পুনঃপরীক্ষণের নামে উত্তীর্ণ বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করলেন। এর দায়ভার কে নেবে। বিএসটিআই পণ্যগুলো পুনঃপরীক্ষণ করলেও যাদের হাইকোর্ট বাজার থেকে সরানোর দায়িত্ব দিয়েছেন, তারা সে সম্পর্কে কতটুকু জানেন? ফলে মানহীন ৫২টি পণ্য নিয়ে বিএসটিআই নিজেই পানি ঘোলা করছে। আর তার ভার নিতে হলো নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরকে। নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো পণ্য মানহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সেই উৎপাদক প্রতিষ্ঠান তার নিজ দায়িত্বে তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো বাজার থেকে সরাবেন। কিন্তু সেটা না করে তৃতীয় কোনো পক্ষকে দায়িত্ব প্রদান করা হলে তা কতটুকু যুক্তিসংগত ও বাস্তবসম্মত? কারণ ওই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানই জানে কোথায় কোথায় তাদের পণ্য বাজারজাত করা হয়ে থাকে। তাদের চ্যানেলে সেগুলো ফেরত আনা সহজ। অন্যদিকে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ একটি নবীন প্রতিষ্ঠান। যাদের বয়স এখন তেমন একটা হয়নি। ঢাকা শহরে গুটিকয়েক কর্মকর্তা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও লোকবল, লজিস্টিক এখনো তেমন একটা হয়নি। আর জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে অফিস প্রতিষ্ঠা করলেও এখনো লোকবল ও অন্যান্য সুবিধাদি তেমন একটা হয়ে ওঠেনি। তাই তাদেরকে বিএসটিআইয়ের মান সনদপ্রাপ্ত নিম্নমানে পণ্যগুলো বাজার থেকে সরানোর দায়িত্ব প্রদান কতটুকু বাস্তবসম্মত হলো, তা বিবেচনার প্রশ্ন রাখে।

বিএসটিআই আইন অনুযায়ী মান সনদপ্রাপ্ত খাদ্য ও পণ্যের মান প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে তার ফলাফল ভোক্তাদের কাছে প্রকাশ করার নিয়ম থাকলেও বিএসটিআই তাদের ওপর অর্পিত সে দায়িত্ব পালনে আগ্রহী নয়। সে কারণে বাজারে আসল নকল খাদ্য, কসমেটিকস, ইলেকট্রিক্যাল পণ্যে বিএসটিআইয়ের লোগো লাগিয়ে বাজার সয়লাব। আসল নকল পার্থক্য বের করা কঠিন।

তাই এখন সময় এসেছে জাতীয় মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসটিআইয়ের মান পরীক্ষা করে দুর্নীতি ও অনিয়মে আকুণ্ঠ নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানকে উদ্ধার করে তার নিজের মান ঠিক করা। তাদের মান সনদ নিয়ে যেসব খাদ্যপণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে তাদের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলেই বিএসটিআই ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে তার দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে। মান সনদ প্রদানে অহেতুক গড়িমসি ও হয়রানি বন্ধে নাগরিক পরিবীক্ষণ জোরদার করা। মান পরীক্ষায়, বাজার তদারকিতে বিএসটিআইয়ের কার্যক্রমগুলোকে নাগরিক পরিবীক্ষণের আওতায় আনা, পুনঃপরীক্ষণ হতে হলে তৃতীয় পক্ষের পরীক্ষাগারে হওয়া উচিত এবং সেখানে বিএসটিআই ও সংশ্লিষ্ট উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ভোক্তা প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাব ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে নিষিদ্ধ ঘোষিত সব পণ্য বাজার থেকে তুলে নিতে বিএসটিআইকেই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। পণ্য পরীক্ষণ কার্যক্রমে ভোক্তা প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাব ও গণমাধ্যমের উপস্থিতি ও ভূমিকা আরো জোরদার করা এবং মাঠপর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে নিরাপদ ও মানসম্মত খাদ্য ও পণ্য নিশ্চিত হবে।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কেন্দ্রীয় কার্যকরী পর্ষদ

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close