আহমদ আবদুল্লাহ

  ২৯ এপ্রিল, ২০১৯

বিশ্লেষণ

জাতি-গোষ্ঠীর উত্থানপতন

একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অধীনে প্রতিটি সৃষ্টির চলাফেরা ও চালচলনের ভিন্ন ভিন্ন নিয়মকানুন রয়েছে। এ নিয়মের মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম হয় না, হেরফের হয় না। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, একজন ব্যক্তি যেমন তার জীবনকালে শৈশব, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য, সুস্থতা, ব্যাধিগ্রস্ততা, সাবলতা প্রভৃতি স্তর অতিক্রম করে; তেমনি একটি জাতি ও জনগোষ্ঠীও অতিক্রম করে জীবন, মৃত্যু, উত্থানপতন, দুর্বলতা, সাবলতা প্রভৃতি স্তর। যার নিয়মকানুন স্বয়ং আল্লাহ তাদের জন্য বেঁধে দিয়েছেন। আর বেঁধে দেওয়া ওইসব নিয়মকানুনের প্রতি কোরআনে বারবার মানবজাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেমন বিশ্বের মানুষের উত্থান এবং সেটাকে বহাল রাখার যে নিয়ম আল্লাহ রেখেছেন, তা হলো সংশ্লিষ্ট জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে কিছুসংখ্যক লোকের এমন একটি দল বিদ্যমান থাকবে যারা অপরাপর লোকদের সৎকর্মের নির্দেশ দেবে অসৎকার্য হতে বারণ করবে। অন্য কথায়, এই দল আপন জাতি-গোষ্ঠীকে সংস্কার-সংশোধন করার এবং তাদেরকে ফিতনা-ফাসাদ ও দুষ্কর্ম থেকে রুখে রাখার দায়িত্ব পালন করবে।

প্রতিটি যুগেই এমনি একটি দলের অস্তিত্ব ছিল। তবে সময় ও অবস্থা বিশেষে তাদের আকার-প্রকার ও কর্মপ্রণালি ছিল ভিন্ন ভিন্ন। ভিন্ন ছিল তাদের আসবাবসামগ্রী ও মাধ্যমসমূহও। মোটকথা এ ধরনের একটি দল সব সময়ই ছিল এবং তাদের থাকাটা ছিল অপরিহার্য। কেননা, সংশ্লিষ্ট জাতির জীবন, তাদের উত্থান, সসম্মানে ধরাপৃষ্ঠে তাদের টিকিয়ে থাকাটা নির্ভর করত ওই বিশেষ দলটি ওপরই। আর এ কারণে এ দলের জন্য এটা অপরিহার্য ছিল যে, তারা হবে অত্যন্ত চেতনাসম্পন্ন, সজাগ মস্তিষ্ক, পরিশ্রমী, আমানতদার, বিশুদ্ধচিত্ত, নিঃস্বার্থ ও কর্মচঞ্চল। তাদের থাকবে যেকোনো পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, তাদের ইমান হবে মজবুত, নিয়ত ও সংকল্প হবে বিশুদ্ধ, আপন জাতিকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে এবং অসৎ ও ধ্বংসাত্মক পথ থেকে রুখে রাখতে তারা হবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সর্বাবস্থায় আপসহীন। আর এ দল সম্পর্কেই মহান রব বলেন, ‘ওদের প্রতিটি দলের এক অংশ বের হয় না কেন, যাতে তারা দীন সম্বন্ধে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং ওদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়।’ (সুরা তাওবা : ১২২)।

সৎকর্মশীল ও কল্যাণকামী লোকেরা তাদের জাতিকে ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। তারা তাদের জাতির জন্য যেন এক একজন চিকিৎসক। রুগ্ণ জাতি যদি তাদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী চলে, তা হলে তারা রোগব্যাধি থেকে রক্ষা পায়, অন্যথায় তাদের রোগ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং পরিশেষে তারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সত্যের দিকে আহ্বানকারী, মানুষের কল্যাণকামী ও সব রকম যোগ্যতার অধিকার লোকদের কোরআনে ‘সোয়ালিহীন’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি উপদেশের পর যবুরে বলেছি যে, আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দারা পৃথিবীর অধিকারী হবে।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৫)। যাবুর কিতাবে আল্লাহ তার এ নির্ধারিত কানুনটি ঘোষণা করেছেন যে, জমিনের উত্তরাধিকারী আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দারাই হয়ে থাকে। যারা সৎকর্মপরায়ণ ও যোগ্যতাসম্পন্ন এবং যারা দুনিয়াকে সাজাতে ও গড়তে জানে। আর যাদের বিশ্বাস ও কর্ম বিগড়ে যায়, যারা অযোগ্য। গড়ার পরিবর্তে ভাঙে তারা দুনিয়ার উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়। উম্মতে মুহাম্মদির দায়িত্বশীল ও সৎকর্মপরায়ণ বান্দারা দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ পৃথিবীর উত্তরাধিকারী ছিল। প্রাচ-প্রতীচ্যের সর্বত্র তারা ন্যায়বিচারমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল ন্যায় ও সত্যের পতাকা। যেকোনো জাতির মধ্যে নির্দিষ্টসংখ্যক সৎকর্মশীল বান্দার অস্তিত্ব ওই জাতির উন্নয়ন এবং তাদের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। সৎকর্মশীল বান্দাদের যোগ্যতা ও কর্মতৎপরতার মধ্যে যতই ভাটা পড়বে; ততই উম্মতের জীবন এবং তাদের টিকে থাকার মধ্যে অবনতি পরিলক্ষিত হবে। এরপর যখন সৎকর্মপরায়ণ বান্দারা নিষ্কর্মা ও প্রভাবহীন হয়ে পড়বে, তখন বুঝতে হবে ওই জাতির পতন ও ধ্বংসের দিন ঘনিয়ে এসেছে।

যখন কোনো জাতির সচ্ছল ও প্রভাবশালী লোকেরা বল্গাহারা ও পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে, নিজেদের জাতি ও ধর্মের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা তাদের সব মনোযোগ নিজেদের সাময়িক স্বার্থের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে ফেলে এবং যখন ওই জাতির বিবেকবান লোকেরাও তাদের পথভ্রষ্টতা থেকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে না, তখন অনিবার্যভাবে সে উম্মতের ধ্বংসের দিন ঘনিয়ে আসে। কোরআনের ভাষ্য, ‘আমি যখন কোনো জনপদ ধ্বংস করতে চাই, তখন সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তিদের সৎকর্ম করতে আদেশ করি। কিন্তু তারা সেথায় অসৎকর্ম করে; অতঃপর সেই জনপদের প্রতি দন্ডাজ্ঞা ন্যায়সংগত হয়ে যায় এবং তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি। নূহের পর আমি কত মানবগোষ্ঠী ধ্বংস করেছি। তোমার প্রতিপালকই তার বান্দাদের পাপাচারণের সংবাদ রাখা ও পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা বনি ইসরায়েল : ১৬-১৭)। সুতরাং জাতির ক্ষমতাশীল, ধনাঢ্য ও ওপরের স্তরের লোকদের ফিতনা-ফ্যাসাদ ও রুচিবিকৃতিই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে ওই জাতির ধ্বংসের কারণ।

কোনো জাতির আমির, সরদার এবং প্রাচুর্যের অধিকারী ব্যক্তির কুকর্ম দেখে যদি জ্ঞানী ও বিজ্ঞলোকেরা শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন এবং তা থেকে তাদের বাধা না দেন, তা হলে ধীরে ধীরে ওই কুকর্ম সমগ্র জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আর এ অবস্থায় যদি পুণ্যবানরা নিজেদের ব্যক্তিগত পুণ্যকর্ম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। সমষ্টিগত ফ্যাসাদ ও দুষ্কর্ম দেখে তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও উচ্চারণ করেন না বরং নীরবচারী হয়ে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে গোটা সমাজের দুর্ভাগ্যের দিন ঘনিয়ে এসেছে এবং এ জাতিকে অচিরেই কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। যেমনটি আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা এমন ফিতনা সম্পর্কে সতর্ক হও, যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা জালিম কেবল তাদেরকেই ক্লিষ্ট করবে না। জেনে রাখ, আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর।’ (সুরা আনফাল : ২৫)। সমষ্টিগত অপরাধের ব্যাপারে আল্লাহর নিয়ম এটাই। ইসলাম শুধু ব্যক্তিকেই নয়, বরং গোটা সমাজকে পবিত্র ও পুণ্যবান দেখতে চায়।

জুলুম, খুনখারাবি, মূর্খতা ও অসভ্যতা জাতি-গোষ্ঠীর পতন এবং ধ্বংসের এটাও এক কারণ। যেকোনো সমাজ ও যেকোনো দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাধি হলো রক্তারক্তি ও জুলুম-অত্যাচার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, জুলুম-অত্যাচারের কারণে বিশ্বের অনেক বড় বড় সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে, সমাজব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়েছে, সমাজের লোক চরম ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। মজলুমের আহাজারিতে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে সেখানকার আকাশ-বাতাস। পরিশেষে সর্ব শক্তিমান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে জালিমের ওপর এমন সব বিপদ ও শাস্তি নেমে এসেছে, যার কথা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। আর ওই শাস্তিগুলো ছিল ভূমিকম্প, বজ্রপাত, দুর্ভিক্ষ, আগুন কঠিন কঠিন রোগব্যাধি এবং ভয়ানক আরো অনেক কিছু। জুলুম-অত্যাচারের ফলে আল্লাহর শাস্তি অবতীর্ণ হওয়াটা ছিল এমন একটি কানুন; যা কখনো পরিবর্তন হওয়ার মতো নয়।

ধনসম্পদের অপব্যবহার, অর্থের অপচয়, অন্যের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করা জাতি-গোষ্ঠীর অধঃপতনের আরেক বড় কারণ। আল্লাহ তার বান্দাদের উত্তপ্ত ভাটিতে ফেলে পরীক্ষা করেন। দেখেন, কে আসল আর কে নকল। তিনি বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে নিশ্চিত তোমাদের ধনসম্পদ ও জীবন সম্বন্ধে পরীক্ষা করা হবে। তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল, তাদের এবং মুশরিকদের কাছ হতে তোমরা অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং সাবধান হয়ে চল, তবে তা হবে দৃঢ়সংকল্পের কাজ।’ (সুরা আল ইমরান : ১৮৬)। প্রতিটি যুগেই মুমিন মুসলমানরা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। এখনো বিশ্বের মুসলমানরা নানা পরীক্ষার সম্মুখীন। এ অবস্থায় তাদের দৃঢ়তা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও বীরত্ব প্রদর্শনের সর্বাধিক প্রয়োজন। যারা পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার পর সাহস হারিয়ে বাতিল ও অন্যায়ের সঙ্গে আপন করেন তাদের কপটতা ও সুবিধাবাদের ওপর আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল অভিসম্পাত করেছেন। বর্তমান অবস্থায় মুমিন মুসলমানদের একটি দল বাতিলের সঙ্গে আপস করে চলছেন; যা কোরআনের তথ্যানুযায়ী তাদের লাঞ্ছনা ও বাঞ্ছনার একটি অনিবার্য কারণ।

জাতির মধ্যে যখন পরস্পর মতবিরোধ ও দলাদলি সৃষ্টি হয়, একতা ও ঐক্যের শৃঙ্খলা যখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়; তখন জাতি হারিয়ে ফেলে তাদের মানমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি। অধঃপতন তাদের ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে। যেমনটি কোরআনে এসেছে, ‘নিজেদের মধ্যে বিবাধ করবে না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে।’ (সুরা আনফাল : ৪৬)। মুসলমানদের পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসা এমন একটি নেয়ামত, যেটাকে আল্লাহ তার বিশেষ পুরস্কার বলে নির্ধারণ করেছেন। আক্ষেপ তাদের ওপর, যারা এ নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও নির্বিকার এবং এজন্য তাদের অন্তরে কোনো জ্বালা অনুভব করে না। আজ পারস্পরিক ভালোবাসার পরিবর্তে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদই মুসলিম উম্মাহর বড় পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছেÑ এটাকেই বলা হয় পরিস্থিতির অদ্ভুত বৈপরিত্য।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close