রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

শিশুদের জন্য চাই নিরাপদ পৃথিবী

পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ছে কোনো না কোনো দেশেই শিশুদের ওপর অত্যাচার আর নিপীড়নের বীভৎস ছবি। দেখে মনে হয়, মানুষের বিবেক আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। পৃথিবী জুড়েই শিশু-কিশোররা নানা ধরনের আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। সাধারণত সামাজিকভাবে উন্নত নাগরিকরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলি থেকে শিশুদের যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখা হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর বিপরীত ঘটনাই ঘটে। জার্মানিতে ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের অনৈতিকতায় হাজারো শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। ছয় দশক ধরে বিভিন্ন নথিপত্রের ভিত্তিতে তৈরি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। জার্মান বিশপস কনফারেন্সের সহযোগিতায় এ গবেষণা করা হয়েছে। ৩ হাজার ৬৭৭টি ঘটনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তৈরি করা হয়েছে প্রতিবেদনটি। বুধবার জার্মান পত্রিকা ডেয়ার স্পিগেলে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়। গিসেন, হাইডেলবার্গ ও মানহাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৬ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১ হাজার ৬৭০ জন যাজককে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা, যাদের দ্বারা শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল। যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের বয়স ১৩ বছরের কম এবং তাদের বেশির ভাগই ছেলে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশ নাউরুতে অন্তরীণ কেন্দ্রে থাকা শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের পাঁচটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। নৌপথে অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমানো বিভিন্ন দেশের মানুষকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী এ ধরনের কেন্দ্রে আটক রাখা হয়। অস্ট্রেলিয়া সরকার সব মিলিয়ে অন্তরীণ কেন্দ্রগুলোতে ৪৪ জন আশ্রয় প্রার্থীর ওপর যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তদন্ত করছে।

কিন্তু অভিবাসন দফতর বলেছে, কেন্দ্রগুলোতে এখনো ১২৬টি শিশু রয়েছে। একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সম্প্রতি সিনেট কমিটির শুনানিতে বলেন, নিপীড়নের ঘটনাগুলো তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজও কোনো বিচার হয়নি। আর বাংলাদেশের শিশুদের অবস্থা কমবেশি সবারই জানা। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ মূলত পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা এবং সংস্কার ধূলিসাৎ, সামাজিক ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বিশেষ করে ল্যাপটপ-কম্পিউটার-মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও জবাবদিহিবিহীন ব্যবহারের সুযোগ, পর্নোগ্রাফির অবাধ বিস্তার। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকের আগ্রাসনই ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, দুর্বল সামাজিক কাঠামো, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য, বিচারহীনতা। আরো রয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় সংস্কৃতি চর্চার অভাব, সুষ্ঠু ও সুস্থধারার বিনোদনের অনুপস্থিতি, কিশোর-কিশোরীদের ক্রীড়া-কর্মকান্ডের অভাব ইত্যাদি। এর চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সমাজে যতসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা আমরা শুনি, ততটার বিচারের খবর আমরা পাই না। গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর তেমন একটা দেখা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকরা শুধু পারই পায় না, পুরস্কৃতও হয়। বিশ্বের ১৯ শতাংশ শিশুর বাস ভারতবর্ষে। যে দেশগুলোতে শিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার মধ্যে ভারত অন্যতম। কীভাবে এর মোকাবিলা সম্ভব? চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ভারত উত্তাল হয়েছিল আট বছরের শিশু আসিফার ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ, সমাবেশ হয়েছিল।

বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, গত সাত জানুয়ারি রাজধানীর ডেমরায় বাসায় খাটের নিচ থেকে দুটি শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার নাম করে শিশু দুটিকে বাসায় ডেকে ধর্ষণ করতে চেয়েছে কিছু পশু। ব্যর্থ হয়ে শিশু দুটির একজনকে গলাটিপে এবং আরেকজনকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। একই দিনে রাজধানীর তুরাগ এলাকায় স্কুল থেকে ফেরার পথে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার চেষ্টা করে এক যুবক। এর এক দিন আগে অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গাবতলা গ্রামে আট বছর বয়সী এক শিশু ‘ধর্ষণের’ শিকার হয়। পৃথক আরো একটি ঘটনা ঘটেছে ৫ জানুয়ারি। রাজধানীর গোরিয়ায় দুই বছর ১০ দিনের একটি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ ৫, ৬ ও ৭ তারিখÑ এ তিন দিনে চার শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা অতি নিকট সময়ে ঘটে গেল। ভাবতে অবাক লাগে, এত নিকৃষ্ট কাজ আমার দেশে নিয়মিতভাবে হচ্ছে, যার প্রতিরোধ কেউ করছে না। এ যেন এক নষ্টামি আর ভন্ডামির লাগামহীন লীলাখেলা। দিনের পর দিন এভাবে ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুদের সঙ্গে অন্যায় চলছে আর চলছে। আর সমাজের বিবেকবান মানুষ এটা দেখে নিন্দা জানিয়ে নাক ডেকে ঘুমোতে যায়। বাস্তবে না আছে আমাদের ভেতর দয়া, না আছে ভালোবাসা। যদি থাকত তাহলে এমন নিষ্ঠুর ঘটনাগুলোর পরও আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারতাম না। এ বিষয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্রের কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত। অথচ এর কিছুই দেখছি না। আমরা পত্রিকায় এবং খবরে যা দেখি তা হয়তো সবাই জানি; কিন্তু যা খবরের কাগজে ওঠে না, তা জানতেও পারি না।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পত্রিকার খবরেই ধর্ষণের ঘটনা সীমাবদ্ধ। রোজ দেশের কোনো না কোনো স্থানে চলছে এ নোংরামি, যা হয়তো আমার আর আপনার অজানা। আইনত ১৮ বছরের কম বয়সের একজনকে যদি প্রলুব্ধ করে বা তার সঙ্গে সমঝোতায়ও যৌনকর্মে লিপ্ত হয়, তার পরও সেটা ধর্ষণ। গ্রামগঞ্জে আজকাল ধর্ষণই যেন বিনোদনের উপাদানে পরিণত হয়েছে। ঘরে ঘরে নিকটাত্মীয় কর্তৃকও ধর্ষিত ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় শিশুরা। শিশু-কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে পরিবারে, নিকটাত্মীয় দ্বারা। এসব ঘটনার অনেক কিছুই প্রকাশ পায় না। একইভাবে শিক্ষিত মহল, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মধ্যেও অনেক দুর্ঘটনা রয়েছে, যা প্রকাশ পায় না। আবহমানকাল থেকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনায় প্রধান নিয়ামকের ভূমিকায় রয়েছে পর্নোগ্রাফি। তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেটসহ মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদিতে পর্নো ছবি দেখার মাধ্যমে এ মানসিকতা তৈরি হয় অপরাধীর। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, একজন মানুষ যখন পর্নোগ্রাফি দেখে, তখন তার মস্তিষ্ক থেকে হরমোন নিঃসরণ হয়। যার মাধ্যমে ওই ব্যক্তি যৌনাচারে উৎসাহিত হয়। এ ধরনের মানুষ তখন যৌন আচরণ করার জন্য কুকুরের মতো হয়ে ওঠে। শুধু পর্নোগ্রাফি নয়, মাদকও আরেক নিয়ামক। এমনও অনেক মাদক রয়েছে, যা সেবন করলে সেবীকে যৌনতায় প্রবৃত্ত করে। কিছু কিছু নাটক, চলচ্চিত্রসহ বিশ্ব সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান ধর্ষণে উৎসাহিত করে। এসব উপাদান বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নষ্ট করছে। মেয়েরা ভোগের বস্তুÑ এমন ধারণা তাদের মধ্যে প্রোথিত করছে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ‘স্টেট অব চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ সালে দেশে ৫৯৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে যৌন নিপীড়ন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৪৪৬টি শিশু। অর্থাৎ ওই এক বছরে শিশু ধর্ষণের হার বেড়েছে শতকরা ৩৩ ভাগ। অন্যদিকে শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ বছরে সারা দেশে ২ হাজার ৩২২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে আরো ৬৩৯ শিশু। এ ছাড়াও চার বছরে সারা দেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩১ শিশুকে। পরিসংখ্যান দেখে এটা অন্তত বোঝা যায়, এ নোংরামি কমবে না। আমাদের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে। এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া সেটিরই প্রতিফলন। পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেল, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে ১৪৭ বেড়ে ৫৯৩ শিশু ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয় এবং ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালে ১৫৫ বেড়ে ৭৪৪ শিশু ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাহলে এটা থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে যৌন নিপীড়ন ছাড়া শুধু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৩২২ নিষ্পাপ শিশু। যাদের বয়স দুই থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। প্রতি মাসে গড়ে ৬৪ শিশু ধর্ষণ হয় বাংলাদেশে। আর দৈনিক গড়ে দুটি করে শিশু ধর্ষণ হচ্ছে। জাতীয়ভাবে আমাদের নিজস্ব পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রয়েছে। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা অত্যন্ত মজবুত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব সংস্কৃতির যে সুনামি চলছে, তা আমাদের পারিবারিক-সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধ ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। শুধু রাষ্ট্র আর প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে সামাজিক জাগরণ ও নৈতিকতা শিক্ষারও দরকার আছে। ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। শালীনতা, মানবতা বিষয়ে সব ধর্মেই আলোচনা করা হয়েছে; যা প্রত্যেক মানুষের মেনে চলা উচিত। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ধর্ষণ চলতেই থাকবে। তাই এসব অমানবিক ঘটনা রুখতে অতি দ্রুত সক্রিয় হতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে। সুুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা, নৈতিক চরিত্র গড়ে তোলা, ন্যায়ের সমর্থন ও অন্যায়ের প্রতিরোধমূলক মূল্যবোধ গড়ে তোলার মতো সামাজিক পরিবর্তনের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থাও নিতে হবে। তাহলে হয়তো এ ঘৃণ্য সহিংসতা থেকে মুক্তি পাবে এ দেশের নিষ্পাপ কন্যাশিশুরা। এ নির্মমতা প্রতিরোধ করা না গেলে সামনে হয়তো আরো খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তাই শিশু ধর্ষণ ও হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close