এস এম মুকুল

  ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

শিক্ষা সাফল্যে বাংলাদেশ

সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশের ওপরে অবস্থানের মাধ্যমে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। ক্ষেত্র চারটির তিনটি হলো ছেলে ও মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়েদের সমতা এবং সরকারপ্রধান হিসেবে কত সময় ধরে একজন নারী রয়েছেন। চতুর্থটি হলো জন্মের সময় ছেলে ও মেয়েশিশুর সংখ্যাগত সমতা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো করেছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সূচকে। এ সূচকে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। অর্থাৎ পৃথিবীতে যেসব দেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সবচেয়ে বেশি হয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। শিক্ষায় অংশগ্রহণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬তম। এ ক্ষেত্রেও কিছু উপসূচক আছে। এর মধ্যে সাক্ষরতার হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়েদের সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে ১ নম্বর অবস্থান পেলেও উচ্চশিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১২১তম। সাম্প্রতিক বিশ্বসূচকে বাংলাদেশের শিক্ষা, নারী সমতা ইত্যাদি ক্ষেত্রেগুলো আশাব্যঞ্জক অবস্থানে। তবে আমাদের আজকের আলোচনা সমকালীন বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতি নিয়ে।

উচ্চশিক্ষায় ছেলেমেয়ে সমতা : সরকারের পদক্ষেপের কারণে উচ্চশিক্ষায়ও অংশগ্রণ বেড়েছে। প্রায় ৩১ লাখ শিক্ষার্থী বর্তমানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। বর্তমানে ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে মোট শিক্ষার্থীর ৬৩ শতাংশ পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণার সুযোগও বাড়ছে। একসময় বছরে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু ভারতে উচ্চশিক্ষা নিত, যা এখন শূন্যের কোঠায় নেমেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ৬৩০ জন বিদেশি শিক্ষার্থীও অধ্যয়ন করছে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ৫১ শতাংশ ও ছেলেদের ৪৯ শতাংশ। মাধ্যমিক স্তরে মেয়ে ৫৩ শতাংশ ও ছেলে ৪৭ শতাংশ। ছয়-সাত বছরের মধ্যে উচ্চশিক্ষায়ও ছেলেমেয়ে সমতা অর্জিত হবে। এখন প্রায় শতভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪৮ থেকে ২১ শতাংশে নেমেছে।

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম : কিছুদিন আগেও গ্রামের স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম অকল্পনীয় ছিল। এখন যে গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, সেখানেও সোলার প্যানেলে চালানো হচ্ছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। ডিজিটাল কনটেন্ট, ভিডিও এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে পুরো বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। ২৩ হাজার ৩৩১টি মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল ও মাদরাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। প্রাথমিকের প্রায় ৬৬ হাজার স্কুলেও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালুর জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে ডিজিটাল বই।

ক্লাস পরীক্ষায় শৃঙ্খলা : ক্লাস-পরীক্ষায় শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। আগে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, কলেজে ভর্তি ও ক্লাস শুরুর জন্য নির্ধারিত সময় ছিল না। কয়েক বছর ধরে নির্ধারিত সময়ে পাবলিক পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষার ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশিত হচ্ছে। ১ জানুয়ারি বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্লাস শুরু হচ্ছে। ১ জুলাই উচ্চ মাধ্যমিকে ক্লাস শুরু হচ্ছে। ভর্তি কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন হচ্ছে। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য রাজধানীর বেশির ভাগ স্কুলে আবেদন করতে হয় অনলাইনে। জিপিএর ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা পছন্দের কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়।

বিনামূল্যের বই উৎসব : বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে দুঃসাহসিক, যুগান্তকারী ও আশাজাগানিয়া বিশাল সফল কর্মযজ্ঞ বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ। সরকারের বড় অর্জন সব শিশুকে বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে বই হাতে তুলে দেওয়া। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং ঝরে পড়া রোধের লক্ষ্যে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ হতে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে প্রাক-প্রাথামিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বছরের প্রথম দিবসে ১৮৯ কোটি ২১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯৫টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সফলতার অনন্য রেকর্ড করেছে। বিশ্বের কোনো দেশে এত বই বিনামূল্যে বিতরণের রেকর্ড নেই।

বাড়ছে কারিগরি শিক্ষার হার : ২০০৯ সালে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার হার ছিল ১ শতাংশেরও কম। ছয় বছরে এ হার ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২০ সালের মধ্যে এ হার ২০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

উৎসাহের উপবৃত্তি : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি, ঝরেপড়া রোধ করা, বাল্যবিবাহ রোধ করা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা অনেক বাড়িয়েছে। বাড়ানো হয়েছে মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষার ধাপ।

নারী শিক্ষায় সাফল্য : বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ভেতরে বাংলাদেশ সবার ওপরে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল সে সময় ৮০ শতাংশ নারী ছিল শিক্ষা বঞ্চিত। ব্যানবেইসের হিসাবে ২০১২ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫১ শতাংশই ছিল মেয়েশিশু। প্রায় শতভাগ মেয়েই এখন স্কুলে যাচ্ছে। প্রাথমিকে শিক্ষকতায় ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক নিয়োগদান করা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সবার জন্য বৃত্তি থাকলেও, মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধু মেয়েদের জন্য বৃত্তি রাখা হয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষায় সাফল্য : দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও অর্জিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। দশ বছর আগে যেখানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ। বর্তমানে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা শতভাগ। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির হার ৫১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬২ শতাংশ, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তির হার ৩৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৪ শতাংশ এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে। বাংলাদেশে বয়স্ক শিক্ষার হার উন্নীত হয়েছে ৫৯ শতাংশে। গ্রাম-শহর উভয় অঞ্চলেই বেড়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার হার। উপবৃত্তির কারণে স্কুলগামী মেয়েশিশুর হার বেড়েছে। স্কুলে খাবার কর্মসূচিও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।

কারিকুলাম সংস্কার, যুগোপযোগী সিলেবাস : শিক্ষানীতির আলোকে কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে সরকার। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব বই পড়ানো হতো, তা লেখা হয়েছে ১৯৯৫ সালে প্রণীত কারিকুলাম অনুসারে। এ সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশেষ করে প্রযুক্তির জগতে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। প্রায় দেড় হাজার শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক ২ বছর ধরে কাজ করে নতুন যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রস্তুত করে। কারিকুলাম যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কারিকুলামের বৈশিষ্ট্য, নম্বর বিন্যাস, বিষয় সংযোজন-বিয়োজনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, জীবনমুখী শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্ম ও জীবনভিত্তিক শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা, ক্যারিয়ার এডুকেশন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, চারু ও কারুকলা নতুন বিষয় হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে।

সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি : মুখস্থ করে বা নকল করে পাস করার দিন এখন আর নেই। এখন পড়তে হবে, বুঝতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে। বদলে গেছে সনাতন ধারার পাঠ ব্যবস্থাপনাÑ প্রণয়ন করা হয়েছে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি। ২০১০ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় ২টি বিষয় বাংলা ও ধর্মে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়। ২০১১ সালে এতে যুক্ত হয়েছে ৫টি বিষয়। ২০১২ সালে গণিত ও উচ্চতর গণিত বাদে ২১টি বিষয়ে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে। দাখিলে ২০১১ সালে বাংলা ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু হয়। ২০১২ সালে নতুন ৩টি বিষয় যুক্ত হয়েছে। ২০১৩ সালে আরো ৩টি যুক্ত করা হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষায় ২০১২ সালে প্রথম বাংলা বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু হয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান ও পরীক্ষার ভালো ফল ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে। আমরা সব সময় ভালো কিছুর প্রত্যাশায় থাকি। আগামীতেও প্রত্যাশা পূরণের প্রতীক্ষায় থাকলাম।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close