মো. আশরাফ হোসেন

  ১০ জুন, ২০১৮

মতামত

সাধ্যের মধ্যে ওষুধমূল্য

বাংলাদেশে ড্রাগ অধ্যাদেশ ১৯৮২ স্থানীয় ওষুধশিল্পটিকে ব্যাপক উন্নতি করেছিল। ওই অধ্যাদেশটির চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যেমন : ১. এটা সব ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন জেনেরিক নামে করা বাধ্যতামূলক করেছিল; ২. সরকারি ঔষধ প্রশাসন থেকে আবশ্যকীয় সব ওষুধের মূল্য অনুমোদন বাধ্যতামূলক করেছিল; ৩. যেহেতু ভিটামিন রোগমুক্তির জন্য আবশ্যকীয় নয়, তাই ভিটামিন বিদেশি উৎপাদনকারীদের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল এবং ৪. যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ওষুধ হিসেবে বিক্রি হচ্ছিল কিন্তু রোগ নিরাময়ে যেগুলোর কোনো কার্যকর ভূমিকা ছিল না, সেগুলো উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

অধ্যাদেশটি জারির পর যেসব বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি বাংলাদেশে ওষুধ উৎপাদন এবং আমদানি করে আসছিল, তারা ওষুধ সরবরাহ হ্রাসের কৌশল অবলম্বন করে। তারা কিছু ওষুধ উৎপাদন হ্রাস করে, কিছু উৎপাদন বন্ধ করে এবং আমদানিও কমিয়ে দেয়। তারা বাংলাদেশ থেকে তাদের ওষুধ ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার হুমকি দেয়। তাদের ধারণা ছিল, তাদের ওই কার্যকলাপে দেশে ওষুধের সংকট সৃষ্টি হবে এবং সরকার ওষুধ অধ্যাদেশ বাতিল করবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। স্থানীয় ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিসমূহ, যা বহুজাতিক কোম্পানির অসৎ আগ্রাসী বিপণন কৌশলের কারণে খুব পেছনে পড়েছিল, তারা তাদের মানসম্পন্ন উৎপাদিত ওষুধ বিক্রির প্রতিযোগিতাবিহীন সুযোগ পেয়ে যায়। এক দশকে তারা যথেচ্ছ অর্থ উপার্জন করে এবং বহু প্রকারের ওষুধ অধিক পরিমাণে উৎপাদন করে বিপণন করতে থাকে। এরপর অবশ্য কিছু নতুন স্থানীয় কোম্পানিও ওষুধশিল্পে যুক্ত হয় এবং ভালো ব্যবসা করতে থাকে। খবরের কাগজের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে বার্ষিক ওষুধ উৎপাদনের পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশের ওষুধের চাহিদার ৯৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত ওষুধ দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ উৎপাদন করে চলেছে এবং কতিপয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ১২০টি দেশে ওষুধ রফতানি করছে। তবে দেশে দেশে ওষুধ বিপণনের বাধ্যবাধকতার কারণে ওষুধের রফতানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য নয়। তবে আশার কথা, ধীরে ধীরে তা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

নব্বইয়ের দশকে কতিপয় দেশি ওষুধ প্রস্তুতকারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক সরকারকে প্রভাবিত করে ওষুধ অধ্যাদেশ পরিবর্তন করেছে। এতে করে অধিকাংশ ওষুধের মূল্য খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মানুষের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে জেনেরিক নামে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের বাধ্যবাধকতা নেই। এতে করে এমনকি মধ্যবিত্ত লোকদেরও চিকিৎসাব্যয় ভোগান্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখনো দেশের অধিকাংশ লোক দরিদ্র ও অতিদরিদ্র। রোগ হলে তারা দুঃস্বপ্নের অবস্থায় পড়ে যায়। অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ক্রয়ে ব্যর্থ হয়ে ওষুধ বিক্রেতা দোকানির পরামর্শ মতে ওষুধ সেবন করে থাকে।

জেনেরিক নামে ওষুধ বিপণনের বাধ্যবাধকতা না থাকাতে একই ওষুধ বিভিন্ন উৎপাদনকারী নিজ নিজ ইচ্ছা অনুসারে মূল্য ধার্য করে থাকে। যেমন : গ্লিকলাজাইড বিপি ৮০ মিলি গ্রাম ১০০ টেবলেট গ্লিকলিড ব্র্যান্ড নামে টাকা ৭০০ মূল্যে একটি প্রতিষ্ঠান বিক্রি করছে, যেখানে একই গ্লিকলাজাইড বিপি ৬০ মিলি গ্রাম ১০০ টেবলেট অন্য একটি প্রতিষ্ঠান ডায়ামাইক্রোন ব্র্যান্ড নামে টাকা ১ হাজার ৮০০ দরে বিক্রি করছে। জেনেরিক নাম ব্রমাজেপাম বিপি ৩ মিলি গ্রাম ১০০ টেবলেট নোটেন ব্র্যান্ড নামে টাকা ৪০০ দরে একটি কোম্পানি বিক্রি করছে। সে একই টেবলেট অন্য একটি কোম্পানি লেক্সটানিন ব্র্যান্ড নামে টাকা ৭০০ মূল্যে বিক্রি করছে। একইভাবে এটোভাস্টাটিন ক্যালসিয়াম ২০ মিলি গ্রাম ৩০ টেবলেট ভাস ব্র্যান্ড নামে ৬০০ টাকায় বিক্রি করছে এক কোম্পানি। অন্য একটি কোম্পানি একই ওষুধ লিপোস্ট্যাট ব্র্যান্ড নামে ৩৬০ টাকায় বিক্রি করছে। এরা সবাই বাংলাদেশে স্বনামধন্য ওষুধ উৎপাদনকারী। এমন হাজার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের ওষুধ বাজার থেকে উল্লেখ করা যাবে। রোগীরা ওষুধের জেনেরিক নাম বা ব্র্যান্ড নাম কোনোটাই জানে না। তারা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের ওপর নির্ভর করে। বৃহৎ ওষুধ উৎপাদনকারীদের বিপণন কৌশলে প্রভাবিত হয়ে চিকিৎসকরা উচ্চ মূল্যের ওষুধের ব্র্যান্ড নামে ব্যবস্থাপত্র লিখে থাকে, যদিও দেশে স্বল্পমূল্যের মানসম্পন্ন ওষুধ বাজারে বিদ্যমান। এটা বলা হয়ে থাকে, কতিপয় বৃহৎ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে জনপ্রিয় চিকিৎসকদের উৎকোচ প্রদান করে, যাতে তাদের ব্র্যান্ড নামে ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখে। উৎকোচ হিসেবে টেলিভিশন, ফ্রিজ, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণের বিমান টিকিট এমনকি নগদ অর্থও দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সমাজব্যবস্থায় চিকিৎসকরা উচ্চশিক্ষিত নাগরিক। তাদের কাছ থেকে স্বচেতন ব্যবহার প্রত্যাশিত। তারা জানে যে দেশের অধিকাংশ লোক আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল নয় এমন রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার সময় অবশ্যই তাদের ব্র্যান্ড ওষুধের মূল্যটি বিবেচনায় আনা প্রয়োজন এবং মানসম্পন্ন তুলনামূলক কম দামের ওষুধ লেখা উচিত। তাদের রোগীদের সহায়তা করা প্রয়োজন যতটুকু তারা পারে। কদাচিৎই তারা এমনটা করে থাকে।

এমনি পরিস্থিতিতে সরকার ওষুধ অধ্যাদেশে এমন ধারা সংযোজন করতে পারে, যাতে উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান জেনেরিক নামে ওষুধ বিপণন করতে বাধ্য হয়। ব্র্যান্ড নামে ওষুধ উৎপাদন নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

বর্তমানে ওষুধ অধ্যাদেশ সংশোধন করে সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণের আগে সরকারের ওষুধ প্রশাসনের কাছ থেকে ন্যায্য মুনাফাসহ ওষুধের উৎপাদন ও বিপণনব্যয় প্রদর্শন করে মূল্য অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ওই বাধ্যবাধকতা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য ওষুধ প্রশাসনের মানবসম্পদ কাঠামো সম্প্রসারণ প্রয়োজন। দেশের অভ্যন্তরে ওষুধ যৌক্তিক মূল্যে বিপণন নিশ্চিতকরণের জন্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। এতে উৎপাদনকারীদের অনৈতিক প্রতিযোগিতা হ্রাস পাবে। ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদেরও মানসম্পন্ন ওষুধ প্রতিযোগিতামূলক মূল্য বিপণন করে মানুষের উপকার করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

প্রিন্ট মিডিয়ার খবরে জানা গেছে, সরকারের বর্তমান ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist