মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ২৯ মে, ২০১৮

ধর্ম

ইতিকাফ : শরয়ী বিধিবিধান

ইতিকাফ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোনো স্থানে কিংবা কোনো গৃহে অবস্থান করা। আর শরিয়তের পরিভাষায় আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুনিয়ার সংশ্রব, বন্ধন, সম্বন্ধ ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল আল্লাহর জন্য মসজিদে অবস্থান করে ইবাদত করাকে ইতিকাফ বলে।

জাগতিক সমস্ত কার্যকলাপ থেকে মুক্ত হয়ে একজন মানুষ কেবলই আল্লাহর উপাসনায় মগ্ন থাকেন। কোনো ধরনের গুনাহ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। মুক্ত থাকেন তিনি অশ্লীল ও ফাহেশাপূর্ণ কথাবার্তা থেকে। তার চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ ও ভাবনাগ্রস্ত শুধুই মহান রাব্বুল আলামিনকে ঘিরে। তাই অতিদ্রুত তার সঙ্গে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হতে থাকে। আল্লাহ তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন। আবদুল্লাহ ইবনুল আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, ইতিকাফকারী ওই ব্যক্তির ন্যায়, যে বাইরে থেকে সব নেক কাজ করে, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, তার জন্য নেকি লেখা হয়। (মিশকাত : ২১০৮)। রাসুল (সা.) রমজানের শেষ দশকে অধিক পরিমাণে ইবাদত করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.) সারারাত জেগে থাকতেন ও নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন এবং তিনি নিজেও ইবাদতের জন্য জোর প্রস্তুতি নিতেন। (মুসলিম : ২৬৫৮) আর তা সম্ভব হয় ইতিকাফের মাধ্যমে। রাসুল (সা.) শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী (সা.) রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন। (মুসলিম : ২৬৫১)।

রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফ সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার যেকোনো একজন ইতিকাফ করলে মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে ইতিকাফ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু মহল্লার একজন ব্যক্তিও যদি ইতিকাফ না করে, তবে মহল্লার সবার সুন্নত পরিত্যাগের গুনাহ হবে। (দুররে মুখতার : ২/৪৪০)। ২১ তারিখের রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ইতিকাফের সময়। কারণ রাসুল (সা.) প্রত্যেক বছর এই দিনগুলোতেই ইতিকাফ করতেন। এ কারণে এটাকে সুন্নত ইতিকাফ বলা হয়।

মান্নতের ইতিকাফ ওয়াজিব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যেন তাদের মানত পূর্ণ করে।’ (সুরা হজ : ২৯)। তাতে কোনো শর্ত থাকুক বা না থাকুক। যেমন : কেউ বলল, ‘আমার এ কাজ সমাধা হলে আমি ইতিকাফ করব’, এতে যেমন ইতিকাফ ওয়াজিব হবে, ঠিক তেমনই কেউ যদি বলে, ‘আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইতিকাফ করব’, এ অবস্থাতেও ইতিকাফ করা ওয়াজিব বলে সাব্যস্ত হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১৩, দুররে মুখতার : ২/৪৪১) সুন্নাত ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে তা কাজা করা ওয়াজিব।

উপরোক্ত দুই প্রকার ইতিকাফ ছাড়া বাকি সব ইতিকাফ নফল। এ ইতিকাফ মানুষ যেকোনো সময় করতে পারে। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতক্ষণ চায় করতে পারে। রোজারও প্রয়োজন নেই। এমনকি যখনই মসজিদে প্রবেশ করবে নফল ইতিকাফের নিয়ত করা সুন্নত।

ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদুল হারাম, এরপর মসজিদে নববী, এরপর মসজিদে আকসা। এরপর জুম’আ মসজিদ, এরপর যে মসজিদে বেশি মুসল্লি সালাত আদায় করে থাকেন। ইমাম আবু হানিফা (র.) বলেন, ইতিকাফ সহিহ হবে এমন মসজিদে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামায়াতের সঙ্গে আদায় করা হয়। যাদের সামর্থ্য আছে তারা যেন মসজিদে হারামে ইতিকাফ আদায় করে। এটি সওয়াবের ও জামায়াতের দিক থেকে সর্বোত্তম।

মুসলমান হওয়া, পাগল না হওয়া, বালেগ হওয়া, নিয়ত করা, ফরজ গোসলসহ হায়েজ নেফাছ থেকে পবিত্র হওয়া, রোজা রাখা। মসজিদে ইতিকাফ করা। ইমাম মালিক (র.)-এর মতে জামে মসজিদে ইতিকাফ করা উত্তম। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (র.)-এর মতে যে মসজিদে জামায়াত সহকারে সালাত হয় না, সে মসজিদে ইতিকাফ জায়েজ নেই।

রমজানে ইতিকাফকারীদের ২০ রমজানের সূর্যাস্তের আগে মসজিদের সীমানায় প্রবেশ করতে হবে। শেষ ১০ দিনের ইতিকাফ সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া। অর্থাৎ মহল্লার যেকোনো একজন ইতিকাফ করলে মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে ইতিকাফ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু মহল্লার একজন ব্যক্তিও যদি ইতিকাফ না করে তবে মহল্লার সবার সুন্নাত পরিত্যাগের গুনাহ হবে। ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস, চুম্বন, স্পর্শ নিষেধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত হবে না। (সুরা বাকারা : ১৮৭)। শরীরের কিছু অংশ যদি মসজিদ থেকে বের করা হয়, তাতে দোষ নেই। নবী করিম (সা.) ইতিকাফ অবস্থায় নিজ মাথা মসজিদ থেকে বের করতেন। তখন আম্মাজান আয়েশা (রা.) তাঁর মাথার চুল বিন্যস্ত করে দিতেন। (বোখারি : ২৯২)।

নারীরাও ঘরে কোনো স্থান নির্দিষ্ট করে ইতিকাফ করতে পারে। তবে তার জন্য স্বামীর অনুমতি আবশ্যক। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হায়েজ ও নেফাস থেকে পাক থাকতে হবে। তারা ঘরে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করবেন। এটা মহিলাদের জন্য মসজিদের মতো। অর্থাৎ পানাহার, নিদ্রা সে জায়গায়ই করতে হবে। যদি শারীরিক বা শরয়ী কোনো প্রয়োজন না হয়, তবে অত্র স্থান ত্যাগ করলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। যদি ঘরে শুরু থেকেই নামাজের স্থান নির্দিষ্ট থাকে, তাহলে সেখানেই ইতিকাফ করবে। সেখান থেকে সরে অন্যত্র ইতিকাফে বসা জায়েজ নেই। যদি আগে থেকে নামাজের জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারিত না থাকে, তবে ইতিকাফের সময় স্থান নির্ধারিত করে নেবে এবং সেখানে ইতিকাফ করবে। ঘর ছেড়ে মসজিদে ইতিকাফ করা মহিলাদের জন্য মাকরুহ। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২১১)।

ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়া তিন ধরনের হতে পারে। এক. মানবীয় প্রয়োজনে বের হওয়ার অনুমতি আছে। যেমন পায়খানা, প্রস্রাবের জন্য, খাওয়া-দাওয়ার জন্য, পবিত্রতা অর্জনের জন্য। তবে শর্ত হলো এসব বিষয় যদি মসজিদের গ-ির মধ্যে সেরে নেওয়া যায়, তবে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। দুই. এমন সব নেক আমল বা ইবাদত-বন্দেগির জন্য বের হওয়া যাবে না, যা তার জন্য অপরিহার্য নয়। যেমন রোগীর সেবা করা, জানাজাতে অংশ নেওয়া ইত্যাদি। তিন. এমন সব কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না, যা ইতিকাফের বিরোধী। যেমন ক্রয়-বিক্রয়, চাষাবাদ ইত্যাদি। ইতিকাফ অবস্থায় এসব কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ বাতিল হয়ে যায়।

ইতিকাফ অবস্থায় চুপ থাকলে সওয়াব হয়, এই মনে করে চুপ থাকা মাকরুহ তাহরীমী। বিনা জরুরতে দুনিয়াবি কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরুহ তাহরীমী। যেমন, ক্রয়-বিক্রয় করা ইত্যাদি। তবে নেহাত জরুরত হলে যেমন ঘরে খোরাকি নেই এবং সে ছাড়া কোনো বিশ্বস্ত লোকও নেই এরূপ অবস্থায় মসজিদে মালপত্র উপস্থিত না করে কেনাবেচার চুক্তি করতে পারে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইতিকাফকারীর জন্য এ নিয়ম পালন করা জরুরি। ১. সে যেন কোনো রোগী দেখতে না যায়। ২. কোনো জানাজায় শরিক না হয়। ৩. স্ত্রী সহবাস না করে। ৪. স্ত্রীর সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি না করে। ৫. প্রয়োজন ছাড়া কোনো কাজে বের না হয়। ৬. সওম ছাড়া ইতিকাফ না করে এবং ৭. জামে মসজিদ ছাড়া যেন অন্য কোথাও ইতিকাফে না বসে। (মিশকাত : ২১০৬)।

পবিত্রতার জন্যই রোজা ও ইতিকাফ। পরিচ্ছন্নতার জন্য এর প্রয়োজন এবং জীবনকে একটি বলিষ্ঠ শৃঙ্খলার মধ্যে আনয়ন করাই এর উদ্দেশ্য। আত্মশুদ্ধি লাভ করে মানুষ যেন উন্নততর মহত্তর চারিত্রিক গুণাবলি অধিকারী হতে পারে, সংযম অভ্যাস করে মহান রাব্বুল আলামিনের বিধিনিষেধ পালনে অভ্যস্ত হতে পারে, সবার ওপরে এ জীবন সাধনার মাধ্যমে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হতে পারে, এ জন্যই রোজা ও ইতিকাফের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে, এই পবিত্র রমজানে সিয়াম সাধনা ও ইতিকাফের মাধ্যমে সে লাভ করবে নতুন ইমান, নতুন প্রাণ, অফুরন্ত কল্যাণ। লাভ করতে পারবে হাজার রজনির চেয়ে উত্তম রজনি লাইলাতুল কদর।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist