রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২২ মে, ২০১৮

মতামত

আত্মশুদ্ধির মাস রামাদান

ইসলামী শরিয়তে সওম হলো আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে নিয়তসহ সুবেহ সাদিকের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা। সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ তাআলার যিনি রমজানকে শ্রেষ্ঠ মাস বানিয়েছেন এবং সে সময় ভালো কাজের প্রতিদান বাড়িয়ে দিয়েছেন। মেঘমালার মতো দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছে। বছর খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছে। আর আমরা জীবন চলার পথে অলস সময় কাটাচ্ছি। আমাদের মধ্যে কমসংখ্যক লোক এমন আছেন, যারা বাস্তবতা ও পরিণতি নিয়ে চিন্তা করছে অথবা তার থেকে উপদেশ গ্রহণ করছে। বছরের পালা ঘুরে পুনরায় আমাদের দ্বারে এসেছে পবিত্র মাহে রমজান। সিয়ামে রমজান ইসলামের পাঁচ বুনিয়াদি ইবাদতের অন্যতম। এই মাসে সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারা দিন পানাহারসহ সমস্ত বৈধ ভোগ থেকেও বিরত থেকে সংযম-সাধনার অসাধারণ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় আমাদের। অনেকের ধারণা, সারা দিন নিজেদের পানাহার থেকে বিরত রাখার নামই বুঝি সওম বা রোজা। এ ধারণা সঠিক নয়। নিষিদ্ধ প্রতিটি কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার সাধনাই সিয়াম সাধনা।

রোজাদার ব্যক্তির ইফতার করানো একটা পুণ্যের কাজ। কিন্তু এই কাজের মধ্যে যদি লোক দেখানোর প্রবণতা ঢুকে যায়, তাহলে এটার মধ্যেই পুণ্যের বদলে পাপ হতে পারে, এ কথা আমাদের অনেকেরই মনে থাকে না। আমাদের দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ইফতার করানো হয়ে থাকে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। রোজার মাসে দান-খয়রাত এবং জাকাত ইত্যাদি দেওয়া অধিক পুণ্যের কাজ।

কিন্তু ইফতার খাওয়ানো বা দান খয়রাত ও জাকাত দেওয়ার মধ্যে যদি লোক দেখানোর উদ্দেশ্য ঢুকে যায়, তাহলে তা হয়ে পড়ে রিয়া, যা একটি মহাপাপ। রিয়াকে মহাপাপ বিবেচনা করা হয় এই কারণে যে, সমস্ত ইবাদতের মূল লক্ষ্য আল্লাহ তাআলা, তাকে লক্ষ্য করেই সব ইবাদত। অথচ রিয়াতে আল্লাহ ইবাদতের মূল লক্ষ্য নন, মানুষকে দেখানোর জন্যই যদি নামাজ-রোজা করা হয়, তাহলে সেসব ইবাদতের আসল লক্ষ্য হয়ে পড়ে মানুষ। সে ক্ষেত্রে আল্লাহর উদ্দেশে তা থাকে না বলে তা আর আল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হয় না। তা হয়ে পড়ে লোক দেখানো ইবাদত, তথা রিয়া নামক মহাপাপ। বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম মুসলিমপ্রধান দেশ। পবিত্র রমজান মাসে এখানে সিয়ামে রমজানের সুপ্রভাবে ইসলামের চর্চা বেশি বেশি বেড়ে যাবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু রমজান মাস এলেই নিত্যপণ্যের দাম অত্যধিক বেড়ে যায়, তা প্রকারান্তরে ওই ব্যবসায়ীরা রোজাদারদের ওপর জুলুমই করলেন এবং তার মাধ্যমে পাপাচারেই সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করলেন। এটি নিশ্চয়ই একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে আমাদের গৌরবের কথা নয়। রোজা রেখে মিথ্যা, পরনিন্দা বা গীবত প্রভৃতি নিষিদ্ধ কাজে অংশগ্রহণ করলে রোজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনকে সুন্দর, পবিত্র এবং সব ধরনের ত্রুটিমুক্ত করে তুলতে সিয়ামে রমজান এক অনন্য ইবাদত। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সালাত বা নামাজের সঙ্গে তুলনা করলে সিয়ামের গুরুত্ব উপলব্ধি করা সহজ হয়। সালাত বা নামাজের দীর্ঘতম চার রাকাত নামাজ আদায় করতে যেখানে কয়েক মিনেটের বেশি সময় লাগে না, সেখানে একটি সওম বা রোজা আদায় করতে দেশ ও কালভেদে সাধারণত ষোলো-সতেরো ঘণ্টাও লেগে যায়।

এ দীর্ঘ সময় যদি প্রতিদিন সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহারসহ অনেকগুলো ভোগ লালসার কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা যায় এবং এ রকম যদি পুরো একটি মাস পালন করা যায়, তবে তার সুপ্রভাব বাস্তব জীবনে পড়তে বাধ্য। পবিত্র রমজান তাকওয়া অর্জন ও মুত্তাকি হওয়ার মাস। বরকতময়, কল্যাণময়, অফুরন্ত রহমতের মাস। আল্লøাহ বলেছেন, রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। (হাদিসে কুদসি) এতে বোঝা যায়, পবিত্র রমজান আমাদের জন্য কত গুরুত্বময়। তাকওয়া শব্দের শাব্দিক অর্থ দূরে থাকা, কোনো কর্ম থেকে বেঁচে থাকা, কোনো কিছু ত্যাগ করা। আল্লাহর ভয় অন্তরে রেখে কোনো কাজ করা বা তা থেকে বিরত থাকাই তাকওয়া। আর এ গুণ যারা অর্জন করতে পারে, তারাই মুত্তাকি। মোমিনগণ রোজা রেখে হিংসা, বিদ্বেষ, দুর্নীতি, মিথ্যা, জুলুম, ঠকানো, চুগলখোরি, অযথা আলোচনা, বেহায়াপনা, অন্যায় কাজসহ সব ধরনের পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা চালায়। রাসুল (সা.) বলেন, যে ইমানদারি ও আত্মসমালোচনার সঙ্গে রোজা রাখবে, আল্লøাহ তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। মোমিনগণ রোজা রেখে সারা দিন ইবাদত-বন্দেগিতে কাটান। নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, অজিফা তিলাওয়াত, তসবিহ তাহলিল, জিকির আজগারসহ ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত থাকে। মনের ভেতর খোদাভীতি জাগ্রত থাকে। তাকওয়া অর্জিত হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা (মাহে রমজানে) দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে আসেন এবং ডেকে বলেন, কে আছ এমন যে আমার কাছে নিজের গুনাহ মাফ চাইবে আর আমি মাফ করে দেব। (বোখারি ও মুসলিম)। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে এবং সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা রাখল এবং ইবাদতের জন্য রাত জাগল, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়।

রোজাদারগণ সারা জীবনের গুনাহের ক্ষমা চায়। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ফরিয়াদ জানায়। তিনভাগে বিভক্ত মাহে রমজান মাস। প্রথম দশ দিন রহমত, দ্বিতীয় দশ দিন ক্ষমা বা মাগফিরাত, শেষ দশ দিন নাজাত তথা দোজখের আগুন থেকে পরিত্রাণ। (মিশকাত) এ মাস আত্মশুদ্ধি ও খোদার নৈকট্য লাভের সহজ পথ ও উছিলা। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ইমানদারগণ তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর, যাতে তোমরা খোদাভীরু হতে পার। (সুরা : আল বাকারা : ১৮৩) এক কথায় মাহে রমজান বান্দার জন্য আল্লøাহর মহান নেয়ামত। এ মাসে ইমানদারগণ রোজা রাখে। রোজাদারদের জন্য সুসংবাদ যে, রাসুল (সা.) বলেছেন, জান্নাতের একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়্যান, কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে একমাত্র রোজাদার প্রবেশ করবেন। অন্য কারো এ দরজা দিয়ে প্রবেশাধিকার থাকবে না। আল্লøাহর পক্ষ থেকে ডাকা হবে রোজাদাররা কোথায়? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবেন। আর সবাই ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন। তাদের প্রবেশের পর দরজাটি বন্ধ হয়ে যাবে। আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন না। (বোখারি ও মুসলিম)।

রমজানে মসজিদ হয় কানায় কানায় পূর্ণ। মুসল্লিøদের সমাগমে অন্য রকম দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ইসলাম ও মুসলমানের বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। ইমানদারগণ এ মাসে আল্লøাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট থাকে। সমস্ত পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে চায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, রমজান মাসের প্রথম রাতেই শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং একটি দরজাও তখন আর খোলা হয় না। আর জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, এর একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না।

এ মাসে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেন, হে কল্যাণ অন্বেষণকারী অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত বিরত হও। আর এ মাসে আল্লøাহর পক্ষ থেকে জাহান্নামি বহু লোককে মুক্তি দেওয়া হয় এবং প্রতি রাতে এরূপ হতে থাকে। রমজানে মুমিনগণ একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা, গরিব-দুঃখীদের দান-খয়রাত করে থাকে। রাসুল (সা.) বলেন, রমজান মাসে যে একটি ভালো কাজ করল সে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে একটি ফরজ আদায় করল সে ৭০টি ফরজ আদায় করল। বিভিন্ন স্থানে রোজাদারদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। এতে সামাজিক বন্ধন ও ভ্রাতৃত্বের ঐক্য ফুটে ওঠে। এক কথায় মাহে রমজানের আল্লøাহর সন্তুষ্টি অর্জন, ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি ও জীবন শৃঙ্খলাযুক্ত হয়। সর্বোপরি রমজান পবিত্র কোরআন অবতীর্ণের মাস। আল্লøাহ বলেন, আমি মানুষের হেদায়তের জন্য পথনির্দেশনার বিস্তারিত বর্ণনাসহ সত্য-মিথ্যার মাপকাঠি হিসেবে এ রমজান মাসেই কোরআন নাজিল করেছি। সহস্র রাতের চেয়ে উত্তম রাত পবিত্র লায়লাতুল কদরের রজনি এ মাসে। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে এবং সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরের (ইবাদতের জন্য) রাত জাগরণ করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধসহ ইসলামের নানা ঘটনাপূর্ণ এ মাস। এই মহান মাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু কিছু মানুষ রমজানকে পুঁজি করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চায়। পণ্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট, ভেজাল, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ওজনে ঠকানো, দুর্নীতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে পাপাচারে লিপ্ত থাকে। আল্লাহ তাঅলা সবাইকে হেদায়ত দান করুন। সবাইকে এই মহান মাসের ফজিলত হাসিল করার তাওফিক দান করুন। আমিন!!

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist