ইয়াসমীন রীমা

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

পর্যালোচনা

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও ডিজিটাল কনটেন্ট

বর্তমানে পড়ালেখা কেবল শ্রেণিকক্ষ বা পাঠ্যপুস্তকের বিষয় নয়। পড়ালেখার অঙ্গনে লেগেছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া। প্রচলিত শ্রেণিকক্ষের জায়গা দখল করেছে ডিজিটাল ক্লাসরুম, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তিত হয়েছে ডিজিটাল বই বা পিডিএফ ফাইল এবং ডিজিটাল-মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনা। তাই তো কুমিল্লা জেলার সংরাইশ সালেহা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সালমা আক্তার স্কুলে প্রচারিত মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে অভিমত ব্যক্ত করছিলেন এভাবেÑপরপর বিজ্ঞানের দুটি ক্লাসে মনে হচ্ছিল এ যেন পুরো বিশ্বটাকে দেখছি। প্রথম ক্লাসটিতে দেখানো হচ্ছিল মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং কেমন করে দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়। অন্য ক্লাসটিতে দেখানো হলো পৃথিবী কী?। সংরাইশ সালেহা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিন মোল্লা বলেন, ‘ডিজিটাল পদ্ধতির পাঠদান শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কথা শোনার পর মনের কল্পনায় তাকে শেখার গতানুগতিক পদ্ধতি ছাড়া বাস্তবে অবলোকন করে বিষয়বস্তু সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণায় অতি সহজে জ্ঞান অর্জন করতে পারছেন। এ পদ্ধতির পাঠদানে শিক্ষার্থীরা শোনার চেয়ে অবলোকন করার কারণে তাদের শিক্ষাফল স্থায়ী হচ্ছে। তা ছাড়া মুখস্থ ও গদবাঁধা নিয়মের বাইরে ছবি দেখে শিক্ষাপাঠের আনন্দ লুফে নিচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। এখন ক্লাসে ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যাও বেড়ে গেছে।’

২০১২ সালের ২০ মে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার রিয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসকের মিলনায়তনের শিক্ষাসচিব আবু নাসের চৌধুরী, বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, স্থানীয় একাধিক সংসদ সদস্য, প্রশাসনিক ব্যক্তি প্রমুখের উপস্থিতিতে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের গণিত শিক্ষক মো. বোরহানউদ্দিন, বিনদ কুমার ও কম্পিউটার বিশেষজ্ঞা রীমা বেগম জানান, বিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৮০০ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রজেক্টর ও ল্যাপটপ ছাড়াও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫টি ডেক্সটপ কম্পিউটার রয়েছে। তা ছাড়া রয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস করার জন্য পৃথক রুম ও ল্যাব। প্রতি সপ্তাহে ৪-৫টি ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। এ স্কুলেরই ষষ্ঠ শ্রেণির সীমা আক্তার, নোমান হোসেন, আবিদুর রহমান দুর্জয়, সপ্তম শ্রেণির ফাতিন আঞ্জু বলেন, ভিডিও চিত্র দেখে দ্রুত ক্লাস সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে ক্লাসের পরে খেলাধুলার সুযোগ থাকছে। তা ছাড়া ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে পড়াগুলো আয়ত্তে চলে আসে অতি সহজে।

২০১১ সালে জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে এসেস টু ইনফরমেশন অব বাংলাদেশ (এটুআই) প্রকল্পের আওতায় ইনফরমেশন কমিউনিকেশন অ্যান্ড টেকনোলজি (আইসিটি) মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের প্রকল্পটি পরীক্ষামূলকভাবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রায় ৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালু হয়। তার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় চলতি শিক্ষাবর্ষে ১৫ হাজার স্কুল-কলেজে মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতিতে শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করতে এবং শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যায় বাইরে নিয়ে আসতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালু করা হয়। এ প্রসঙ্গে ইনফরমেশন কমিউনিকেশন অ্যান্ড টেকনোলজি প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘জাতি আধুনিক চিন্তাচেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহ ও নির্দেশনায় শিক্ষাকে আকর্ষণীয় এবং বিনোদনমূলক এবং শিক্ষার্থীদের কাছে সহজে উপস্থাপনের জন্য এ পদ্ধতি চালু করেছে। প্রকল্পের অধীনে ইতোমধ্যে ১৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালুর জন্য ল্যাপটপ, মডেম, সাউন্ডবক্স, স্পিকারসহ প্রজেক্টর দেওয়া হয়েছে।’ কুমিল্লা সরকারি টিচার ট্রেনিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক ইসলামউদ্দিন বলেন, ‘আইসিটি হলো যেকোনো ধরনের তথ্যের উৎপত্তি, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, সঞ্চালন এবং বিচ্ছুরণে ব্যবহৃত সব ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি। এক কথায় আমরা বলতে পারি আইসিটি হলোÑতথ্য ও প্রযুক্তির মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিগত সুবিধা। শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটালরূপের বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল পাঠে আগ্রহী করে তোলাও জরুরি। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে পাঠদানের জন্য আইসিটি-আইয়ের মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে দেশের ১৯টি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের মধ্যে ২৩,৩৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটিতে ৫টি এবং ২০২১ সালের মধ্যে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের সব শ্রেণির সব ক্লাসই মাল্টিমিডিয়া সিস্টেমে পাঠদানে সক্ষম হবে। ২০১২ সালের শুরু থেকে কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৮০০ শিক্ষককে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়ার উপযোগী করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং বর্তমানেও ২৫ শিক্ষককের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে সরকারের উদ্যোগে প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই ডিজিটালকরণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও শিক্ষকদের তৈরি ডিজিটাল কনটেন্ট শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটালকরণের স্বপ্নযাত্রার পথ প্রস্তুত হয়েছে।’

ডিজিটাল শিক্ষা ক্ষেত্র প্রসঙ্গে কুমিল্লা জেলা শিক্ষা অফিসার আবদুর রশিদ সরকার বলেন, ‘ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতি শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে। অর্থাৎ পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে একাধিক সøাইডের সাহায্যে যেকোনো মূর্ত-বিমূর্ত বিষয় অতি সহজেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান যেমন আনন্দময়, তেমনি সহজবোধ্য। সনাতন চক, ডাস্টার, চকবোর্ড দিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক তত্ত্বগত ধারণা যথাযথভাবে দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। কিন্তু ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে একাধিক স্থির বা চলমান চিত্রের সাহায্যে শিক্ষার্থীদের যেকোনো বিষয়ে পূর্ণ ধারণা দেওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণ হবে অনেক বেশি আনন্দদায়ক। বর্তমানে শহরাঞ্চল এমনকি গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশন, ইন্টারনেট প্রভৃতি বিভিন্ন ডিজিটাল উপকরণের সঙ্গে পরিচিত। সরকারি উদ্যোগে মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরির পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে এ ধরনের প্রোগ্রাম তৈরির অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ আমাদের সবার থাকতে হবে। সরকারি উদ্যোগে শিক্ষকদের তৈরি ডিজিটাল কনটেন্ট প্রতিযোগিতা শিক্ষকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করতে শিক্ষকদের ব্যাপক কম্পিউটার জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। শুধু কম্পিউটার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ও মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্ট নিয়ে সøাইড তৈরি এবং ইন্টারনেটের মহাসমুদ্র থেকে বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় ছবি, ভিডিও, অ্যানিমেশনসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ ডাউনলোড করার ধারণাই যথেষ্ট। আর যেকোনো শিক্ষকের এসব বিষয়ে দক্ষ হতে মাত্র ১২ দিনের একটি প্রশিক্ষণ সেশনের প্রয়োজন।’

কোচিং বাণিজ্য বন্ধে মাল্টিমিডিয়া শিক্ষা ও ডিজিটাল কনটেন্ট কি ভূমিকা রাখতে পারে, এই প্রসঙ্গে শিক্ষামূলক সফটওয়্যার নির্মাতা প্রদীপ অধিকারী বলেন, ‘নীতিমালা নয় পাঠ্যক্রম ডিজিটাল হলে এমনিতেই বন্ধ হবে কোচিং বাণিজ্য। সিলেবাসভিত্তিক ডিজিটাল কনটেন্টস তৈরি করে দেশের যে এলাকা ইন্টারনেট অবকাঠামোর আওতায় এসেছে সে এলাকাগুলোয় এফএলভি, জিএলভি, পিএনজি ইত্যাদি ফরমেটে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আর যে এলাকাগুলো ইন্টারনেট অবকাঠামোর আওতায় আসেনি সেখানে কমপ্যাক্ট ডিস্কের (সিডি) মাধ্যমে শ্রেণিভিত্তিক সফটওয়্যার আকারে বিতরণ করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীর সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে। প্রথমত, কোচিং সেন্টারে যাওয়া-আসায় তার ন্যূনতম এক ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হবে। সেবামূলক খাত হিসেবে সরকারেরই এ উদ্যোগ নিতে হবে। এতে স্কুলগুলো ই-লার্নিংয়ের আওতায় এলে এ ডিজিটাল কন্টেনটসগুলো শিক্ষকরা ক্লাসরুমে ব্যবহার করতে পারবেন, পাশাপাশি কোটি কোটি টাকার বই মুদ্রণ ও বিতরণের বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এবং বর্তমান সরকারের লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনে মৌলিক উন্নতি হবে।’

শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তিÑএই মূলমন্ত্র ধারণ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, শিক্ষক কর্তৃক ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির দুটি মডেল উদ্ভাবনের ফলে শিক্ষকরা তাদের তৈরি এসব কনটেন্ট একটি লেখালাপে (ব্লগে) আপলোড করছেন। এতে সবাই মিলে মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যপুস্তক এখন ই-বুক। শিক্ষকদের তৈরি মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট ই-বুকে অন্তর্ভুক্ত করায় ভালো শিক্ষকের ভার্চুয়াল ক্লাসে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও যোগ দিতে পারছে। ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে হচ্ছে সূর্যের মতো। সূর্যের আলো যেমন ধনী-দরিদ্র সবাই নির্বিশেষে ব্যবহার করতে পারে, তেমনি ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের মূল স্রোতে শামিল হতে পারে। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজনে সেতুবন্ধে নির্মিত হবে। বাংলাদেশেও ডিজিটাল শিক্ষা বাস্তবায়নে এমনকি একজন দিনমজুরের সন্তান উচ্চশিক্ষা অর্জনে সক্ষম হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist