ইফতেখার আহমেদ টিপু

  ০৭ এপ্রিল, ২০১৮

জনশক্তি

নতুন বাজার খুঁজতে হবে

বিশ্বের শ্রমবাজারে সংকট চলছে দীর্ঘদিন ধরে। বিশ্ব মন্দা বিশেষত জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছে ভয়াবহভাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাণভোমরার ভূমিকা পালনকারী এই খাতে প্রাণসঞ্চার করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোর দুয়ার বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য এখন কার্যত বন্ধ।

চলতি বছরে বিদেশগামী ১০ লাখ কর্মীর ৯০ শতাংশেরই গন্তব্য পুরোনো বাজার মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। সে ক্ষেত্রেও বিরাজ করছে নানা ধরনের সংকট। সৌদি আরবের নতুন নিয়ম, আমিরাতের ভিসা বন্ধ, কুয়েতের নতুন নিষেধাজ্ঞা, লিবিয়ার অস্থিরতা মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের সংকটকে দীর্ঘায়িত করেছে। মালয়েশিয়ায় সরকারি পর্যায়ে জিটুটি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী প্রেরণ আশার আলো ছড়ালেও তাতে অপ্রত্যাশিত ঝামেলা তৈরি করেছে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (আইসিএস) দেওয়ার নতুন পদ্ধতি।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। সে দেশের নাগরিকদের কর্মসংস্থান বাড়াতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছোটখাটো পদে প্রবাসীদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদগুলোয় সৌদি নাগরিক নিয়োগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। সৌদি সরকারের এ সিদ্ধান্তে দেশটিতে প্রবাসীদের শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি কর্মীদের কাজ পাওয়া ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কারণে ২৬ জন কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানোর পর দেশটিতে বাংলাদেশিদের বদলে ভারত বা অন্য দেশের শ্রমিকদের নির্মাণ ও জাহাজ শিল্পে নিয়োগ করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার অক্ষুণœ থাকলেও উটকো ঝামেলায় তা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একটি বিদেশি কোম্পানি মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য ঢাকায় যে অফিস খুলেছে, তাতে হয়রানির পাশাপাশি বাড়তি অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। বিদেশে কর্মী প্রেরণের খরচ সহনশীল করতে এ ধরনের বাড়তি খরচের খাত বন্ধ করা দরকার। পাশাপাশি শ্রমের নতুন বাজার খুঁজে বের করাও জরুরি।

পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী গিয়েছিলেন ১ লাখ ৩১ হাজার। কিন্তু বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২০১০ সালে সে দেশে যেতে পারেন মাত্র ৯০০ জন। ২০১২ সালে এ সংখ্যা আরো কমে আসে। পরে ২০১৫ সালে যায় ৩০ হাজার ৫০০ জন। ২০১৬ সালে শ্রমিক যায় প্রায় ৪০ হাজার। তবে চলতি ২০১৭ সালে তিন মাস বাকি থাকতেই আগের বছরের সংখ্যা পেরিয়ে ৪২ হাজার শ্রমিক গেছেন মালয়েশিয়ায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রাণভোমরার ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাবস্থার কারণে জনশক্তি রফতানিতে ভাটা সৃষ্টি হওয়ায় এ ব্যাপারে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার ঘটনা তা কাটতে অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।

বিদেশে বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি লোক কর্মরত। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে প্রাণভোমরার কাজ করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় বাঘা বাঘা দেশগুলোর অর্থনীতি মার খেলেও বাংলাদেশ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সক্ষমতা দেখিয়েছে রেমিট্যান্স আয়ের বদৌলতে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা দেশের জন্য শুধু মূল্যবান অর্থ বয়েই আনছেন না, দক্ষ জাতি গঠনেও ভূমিকা রাখছেন। অদক্ষ যেসব মানুষ বিদেশে কাজের জন্য যাচ্ছে, তারা দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হচ্ছে কালক্রমে। কাজ শেষে দেশে ফিরে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে বিভিন্নভাবে। ঘন জনবসতির ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। স্বভাবতই জনশক্তি রফতানি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আশার আলো হয়ে বিরাজ করছে।

দক্ষ জনশক্তি ছাড়াও আরো কয়েকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে জনশক্তি রফতানিতে। সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্মসংস্থান বা কর্মী ভিসা পেতে আচরণের সনদ বা চারিত্রিক সনদপত্রের কথা বলেছে। বিদেশি শ্রমিকরা স্বদেশে কিংবা বিদেশে কোনো অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছেন কিনাÑসে ধরনের তথ্যও যাচাই করবে দেশটি, কর্মপ্রত্যাশীদের সে জন্য স্বদেশ-কর্মক্ষেত্র ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে সনদপত্রের প্রয়োজন।

সরকার দক্ষ কর্মী তৈরিতে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছে উপজেলায়, তবে বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণ দিতে প্রয়োজনীয় সিলেবাস থাকা চাই, জোড়াতালি কিংবা তাৎক্ষণিক কাজ করার প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশের শ্রমবাজারে খুব বেশি লাভ হবে না। যারা বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য নির্বাচিত হবেন, তাদের অবশ্যই বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা সংশ্লিষ্ট দেশে কোনোরূপ অনভিপ্রেত পরিস্থিতির শিকার না হন। এটা দুঃখজনক, বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আমাদের কর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। রোগ, দুর্ঘটনা ও নানা অপঘাতে কর্মীদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দূতাবাসগুলোকে এসব দেশে কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের কল্যাণ, বেতন-ভাতা, সমস্যা-সংকটÑএসব বিষয়ে বিশেষত নজর দিতে হবে।

যেসব দেশের শ্রমবাজারে সমস্যা আছে সেসব দেশে বিশেষ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। জনশক্তি রফতানিতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে সমস্যা-জটিলতার সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অপতৎপরতা রোধে সরকারকে কাঠোর হতে হবে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি রেমিট্যান্স, যা প্রবাসীদের মাধ্যমে আসে, সুতরাং রেমিট্যান্স কমে আসার কারণগুলোর প্রতি যেমন যথাযথ দৃষ্টি দিতে হবে, তেমনি নতুন শ্রমবাজার পেতে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist