মাহফুজ আল মাদানী

  ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

নিবন্ধ

এসো আল্লাহর পথে

আরবি দা’আ শব্দের অর্থ হলো আহ্বান করা, ডাকা, আমন্ত্রণ জানানো, কোনো কিছু চাওয়া। পরিভাষায়, আল্লাহর দিকে অর্থাৎ আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধানের দিকে আহ্বান করা। অথবা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, যা সংবাদ দিয়েছেন তা সত্যসহকারে মানা এবং যা আদেশ করেছেন তা অনুসরণের জন্য কাউকে ডাকা বা ইমান আনার জন্য আহ্বান করা।

আহলে ইলম তথা ইসলামী স্কলাররা একমত যে, আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করা ওয়াজিব তথা আবশ্যক। এটা কি সকলের জন্য আবশ্যক নাকি কেউ কেউ আদায় করলে হয়ে যাবে? সে বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, এটা সকলের প্রতি ওয়াজিব বা আবশ্যক নয়। কেউ কেউ আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে। তাই, আমাদের উচিত আমাদের মধ্য হতে কিছু লোক সদা সর্বদা আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করতে থাকবে। আল্লাহর বাণী, ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।’ Ñ(সুরা আলে ইমরান : ১০৪)।

অন্ধকার হতে আলোর দিকে, অজ্ঞতা হতে জ্ঞানের দিকে, মন্দ থেকে ভালো পথের দিকে মানুষকে আহ্বান করা অতীব জরুরি। পাশাপাশি খারাপ বা মন্দ কাজসমূহ দেখলে তা প্রতিহত করা ইমানের দাবি। হাদিস শরীফের ভাষায়, ‘হজরত আবু সাইদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ দেখবে, সে নিজে তা প্রতিহত করবে। যদি সে সক্ষম না হয়, তবে তার জিহ্বা দ্বারা প্রতিহত করবে। যদি সে তখনও সক্ষম না হয়, তবে অন্তর দ্বারা প্রতিহত করার চিন্তা ও পরিকল্পনা করবে। আর এটাই ইমানের দুর্বল স্তর।’ (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ)। এতে বোধগম্য যে, মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করা নৈতিক দায়িত্ব।

এ সকল আহ্বানকারীর থাকা প্রয়োজন বিশেষ গুণাবলি। নচেৎ তাদের আহ্বানে মানুষ সাড়া না দিয়ে চলে যাবে। আল্লাহর ঘোষণা, ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন, পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় থাকতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)। এ ছাড়া আল্লাহর পথে আহ্বানকারীর মধ্যে থাকতে হবে আদর্শ, চারিত্রিক বৈশিষ্টাবলি। আল্লাহর পথের আহ্বানকারীর যে সকল গুণ থাকা বাঞ্ছনীয় তন্মধ্যে আহ্বানকারী আলেম তথা জ্ঞানী হওয়া অন্যতম। যে আল্লাহর পথে আহ্বান করবে তার আহলে ইলিম হওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ আহ্বানকারী ইসলাম সম্পর্কে পুরো জ্ঞান থাকা দরকার। অজ্ঞ বা মুর্খ আল্লাহর পথের দা’য়ী হতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেন, ‘বলে দিন : এই আমার পথ। আমি আল্লাহর দিকে বুঝেসুঝে দাওয়াত দিই। আল্লাহ পবিত্র। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সুরা ইউসুফ : ১০৮)। এখানে আল্লাহ তা’য়ালা দাওয়াতের ক্ষেত্রে ইলিম বা জ্ঞানের কথা স্পষ্টভাবে আলোকপাত করেছেন।

প্রত্যেক কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহর পথে আহ্বান করার ক্ষেত্রে দা’য়ীকে নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া জরুরি। শুধু আল্লাহর উদ্দেশে তাদের কাজগুলোকে পরিচালিত করতে হবে। লোক দেখানো, দুনিয়াতে কোনো সম্মান বা উচ্চাসন পাওয়ার আশায় এ পথের আহ্বানকারী হওয়া যাবে না। আল্লাহর বাণী, ‘অতএব, তোমরা খাঁটি বিশ্বাস সহকারে ডাক, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ (সুরা গাফির : ১৪)। নবীগণও মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া কিছু চাননি। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘হে আমার জাতি! আমি এজন্য তোমাদের কাছে কোনো মজুরি চাই না; আমার মজুরি তারই কাছে যিনি আমাকে পয়দা করেছেন। তবু তোমরা কেন বোঝ না?’ (সুরা হুদ : ৫১)।

দাওয়াতের ক্ষেত্রে কম গুরুত্বের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দিয়ে আরম্ভ করা। যেমন প্রথমে তাওহীদের দিকে, শিরক বা কুফরি হতে বিরত থাকার জন্য আহ্বান করা। পরবর্তীতে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদির দিকে ধীরে ধীরে আহ্বান করা। অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ছেড়ে কম গুরুত্বের বিষয়কে প্রাধান্য না দেওয়া। যা ছিল নবী-রাসুল এবং সাহাবি-তাবেয়ীগণের পদ্ধতি। কাজেই সেসব পদ্ধতিসমূহকে আমাদের অনুসরণ করা সর্বোত্তম।

দা’য়ীগণ ধৈর্যশীল হবেন। প্রবাদে রয়েছে, ধৈর্যই সাফল্যের চাবিকাঠি।’ আল্লাহর পথে আহ্বানকারীদের ধৈর্যসহকারে কাজ করে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সুরা আল আনফাল : ৪৬)। নবী-রাসুলগণ আল্লাহর পথে আহ্বান করার ক্ষেত্রে ধৈর্যের পরম শিক্ষা প্রদান করে গেছেন। দাওয়াত তথা আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা নবী-রাসুলগণের ভিশন ও মিশন। আর যে ব্যক্তি মানুষকে ওই পথে ডাকছে, সে তো সাধারণ কেউ হতে পারে না। কারণ, সে নবী-রাসুলগণের মিশন পালনে সময় অতিবাহিত করছে। সে নবী-রাসুলদের পেশার অনুসরণ করছে। আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক।’ (সুরা আন নহল : ৩৬)।

আল্লাহর পথে আহ্বান বা দাওয়াত শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহান দায়িত্ব ছিল। আর ওই পথে মানুষকে আহ্বান করা মানে বিশ্বনবীর মহান দায়িত্বের পথে কাজ করা। যা অবশ্যই সম্মান ও মর্যাদার। আল্লাহর বাণী, ‘আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদ ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি।’ (সুরা সাবা : ২৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘পরম কল্যাণময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যাতে তিনি বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হন।’ (সুরা আল ফুরক্বান : ০১)। যারা আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের প্রশংসা করেছেন। তারাই তো সৌভাগ্যবান, যাদের প্রশংসা করেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। যিনি আসমান ও জমিনের অধিপতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি একজন মুসলমান, তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার?’ (সুরা ফুস্সিলাত : ৩৩)। আল্লাহর পথে আহ্বান করা এক প্রকারের জিহাদ। তাই যারা আল্লাহর পথে, কোরআনের পথে, রাসুলের পথে আহ্বান করে প্রকারান্তরে তারা যেন দ্বীন ইসলামের জন্য আল্লাহর পথে জিহাদ করছে। আল্লাহর দ্বীন কায়েমে তারা লড়ছে। তাই তাদের অবস্থান অবশ্যই উপরে, অনেক উপরে। আল্লাহর বাণী, ‘অতএব আপনি কাফেরদের আনুগত্য করবেন না এবং তাদের সাথে এর সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম করুন।’ (সুরা আল ফুরক্বান : ৫২)।

দাওয়াত তথা আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকা তা যেন ইসলাম ও মুসলমানকে সহযোগিতা করা। কেননা, এটা হলো অন্ধকার হতে আলোর দিকে, ভ্রষ্টতা হতে হেদায়াতের দিকে, জাহান্নাম হতে জান্নাতের দিকে, মন্দ কাজ থেকে ভালো কাজের দিকে সর্বোপরি মহান আল্লাহ তায়ালার দিকে আহ্বান করে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতিকে সত্যের সন্ধান দেওয়া। যা অবশ্যই মহৎ ও প্রশংসনীয় কাজ। আল্লাহর ঘোষণা, ‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ় করবেন।’ (সুরা মুহাম্মদ : ০৭)। ইমাম শাওকানী (রহ.) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, এখানে আল্লাহকে সাহায্য করার অর্থ হলো আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করা। যারা আল্লাহর পথে মানুষদের আহ্বান করেন তাদের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে রয়েছে অসীম পুরস্কার ও সম্মাননা। তাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামতের দিন পুরস্কার প্রদান করবেন। সর্বোপরি আল্লাহ তায়ালার পথে আহ্বানকারীদের সম্মান এবং মর্যাদা ইহকাল ও পরকাল উভয়কালেই বিদ্যমান।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist