আলতাফ হোসেন খান

  ২৬ জানুয়ারি, ২০১৮

ইতিহাস

চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সংরক্ষণ

বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি, প্রাচ্যের রাণী বীর প্রসবিনী, মমতাময়ী চট্টলা, আধ্যাত্মিক রাজধানী, বন্দরনগরী, আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরী, কল্যাণ ও পুণ্যময় স্বপ্নপুরী, ঘোষিত বাণিজ্যিক রাজধানী হাজার বছরের ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ জনপদের নাম চট্টগ্রাম। কথিত আছে, বহুকাল আগে চট্টগ্রাম ছিল বনজঙ্গলেঘেরা বিভিন্ন ভয়ংকর পশুর অভয়ারণ্য এবং জিন-ভূতের আখড়া। হজরত বদর আউলিয়া আরব রাজ্য থেকে পাথওে ভেসে এখানে এসে একটি চাটির প্রজ্বালন করেন। তার আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টায় এই অঞ্চল জিন-ভূতমুক্ত হয়। একটি চাটি প্রজ্বালন করলে পুরো অঞ্চল সব প্রতিকূলতা থেকে মুক্তি লাভ করায় এই জায়গার নাম হয়েছে চাটিগাঁ থেকে চাটগাঁ, পরে চট্টগ্রাম। এখনো জামালখান এলাকার বদর আউলিয়ার সেই স্মৃতিবিজড়িত জায়গার স্মৃতিচিহ্ন বিদ্যমান। যা চেরাগী পাহাড় নামে পরিচিত। চাটি মানে চেরাগ। তাই এই পাহাড়ের নাম চেরাগী পাহাড়।

চট্টগ্রাম নামকরণের আরো একটি ইতিহাস রয়েছে। চট্টগ্রাম নামের উৎস অনুসন্ধানে দ্রাবিড় যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা। ‘চট্ট’ চাটি বা চাডি দ্রাবিড়জাত ভাষার প্রকাশ। ‘চোট্টি’ চেট্টি ইত্যাদি শব্দ ও সাদৃশ্য। এই শব্দ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার আগে চট্টগ্রামের নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটক, পরিবাজক ও পন্ডিতদের লিখিত বিবরণ এবং অঙ্কিত মানচিত্রে চট্টগ্রামকে বিভিন্ন নামে খ্যাত করেছিলেন। যেমনÑচিৎ-তৌং-গং, শ্যাঃগাঙ্গ, চৈত্যগ্রাম, চট্টল, চাটিগ্রাম, চাটিগাঁও চতুর্গ্রাম, চাটিগাঁ, সোদকাওয়ান, চাটিকিয়াং, শাতজাম, জেটিগা, দেবগাঁ, দেবগাঁও ইত্যাদি। যখন থেকেই এতদঞ্চলে মনুষ্যবাস শুরু হয়, তখন থেকেই এখানে একের পর এক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল এখান থেকেই।

’৭১-এর আন্দোলনে চট্টগ্রাম : ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র লুট করে চট্টগ্রামের খালাসিরা বিরাট অবদান রাখেন। মহান স্বাধীনতার ঘোষণাও এই চট্টগ্রাম থেকেই দেওয়া হয়েছিল। এক কথায় মানবতার মুক্তির সূতিকাগার এই চট্টগ্রাম।

ঐতিহাসিক ইসলামিক নির্মাণ : ১৬৬৭ সালে এই মসজিদ নির্মাণের পর থেকেই চট্টগ্রামের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হয়ে উঠে আন্দরকিল্লার এই মসজিদ। এই মসজিদের ইমাম-খতিব নিযুক্ত হতেন পবিত্র মদিনার আওলাদে রাসুল (রা.) গণ। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই এই মসজিদ জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য যে, এই মসজিদে প্রতি জুম্মায় চট্টগ্রাম ও এর আশপাশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও মুসল্লিরা এসে নামাজ আদায় করতেন এবং পবিত্র মাহে রমজানের শেষ জুমায় কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেও মানুষের সমাগমের নজির আছে। রোজা, ফিতরা এবং ঈদের চাঁদ দেখা প্রশ্নে এই মসজিদের ফয়সালা চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণ মেনে চলত অবধারিতভাবে। আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মুঘল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট ওপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর এর অবস্থান। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) দীর্ঘ, ৭.৫ গজ (৬.৯ মিটার) প্রস্থ এবং প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২.৫ গজ (২.২ মিটার) পুরু। পশ্চিমের দেয়াল পোড়ামাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মধ্যস্থলে একটি বড় গম্বুজ এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত। ১৬৬৬ সালে নির্মিত এর চারটি অষ্টভূজাকৃতির বুরুজগুলোর মধ্যে এর পেছন দিকের দুটি এখন বিদ্যমান। মসজিদটির পূর্বে তিনটি ও উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মাঝের ও সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, মসজিদটি নির্মাণ কৌশলগত দিক থেকে দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের প্রায় প্রতিচ্ছবি হওয়ায় এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্য বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার জন্ম দেয়। এই মসজিদটি দিল্লি জামে মসজিদের আদলে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মিত বলে এই মসজিদকে পাথরের মসজিদ ‘জামে সঙ্গীন’ও বলা হয়ে থাকে। শুধু স্থাপত্য নিদর্শনেই নয়, শৈল্পিক দিক থেকেও এই মসজিদ উল্লেখ্য। কারণ চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারকস্বরূপ হিসেবে শিলালিপিভিত্তিক যেসব স্থাপনা আছে, সেগুলোর মাঝে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের গায়ের শিলালিপি অন্যতম। মসজিদের মূল ইমারতের প্রবেশ পথে কালো পাথরের গায়ে খোদাইকৃত সাদা অক্ষরে লেখা ফার্সি লিপির বঙ্গানুবাদ যা দাঁড়ায় তা হলো হে জ্ঞানী, তুমি জগৎবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় দ্বিতীয় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি (১৭৬৬ সাল)। এই শিলালিপি থেকে এর প্রতিষ্ঠাতার নামও পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, এই মসজিদে পাওয়া সব শিলালিপির সঙ্গে সিরিয়ার রাক্কা নগরের স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায়।

হাশেমি বংশের পদচারণা : রাসুল (সা.)-এর জামানায় আরবের সেরা বংশ ছিল কুরাইশ। এই কুরাইশ বংশ দুটি গোত্রে বিভক্ত ছিল। ১. হাশেমি গোত্র, ২. উমাইয়া গোত্র। এর মধ্যে উমাইয়ারা ছিল মদ্যপায়ী; তারা মদ, জুয়া, দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়েই ব্যস্ত থাকত। নিজেদের শক্তির আধিপত্য বিস্তার করাই ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। পক্ষান্তরে হাশেমি গোত্র ছিল ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ। আর বিশ্বনবী রাসুল (সা.) এই হাশেমি গোত্রেই জন্ম লাভ করেন। তাই রাসুল (সা.) বলেন, মানব সম্প্রদায় উত্তম ও অধম দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। আল্লাহতায়ালা আমাকে উত্তম শ্রেণিতেই প্রেরণ করেছেন। আমি মাতা-পিতার মাধ্যমেই আগমন করেছি। আর উত্তম জনগোষ্ঠীতে জন্ম নেওয়ার কারণে অধম জনগোষ্ঠীর অজ্ঞতা আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি [তাফসিরে মাজহারি ১ম অংশ, পৃষ্ঠা ১৩৬] তারই ধারাবাহিকতায় আউলিয়া কেরামের স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন পাঁচলাইশ বর্তমানে বায়েজিদ বোস্তামী থানার অন্তর্গত জালালাবাদের এক ধর্মভীরু সম্ভ্রান্ত মুসলিম কাজী পরিবারে হাশেমি বংশে আল্লামা কাজী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শাহ্ সুফি মাওলানা কাজী আহছানুজ্জমান হাশেমি (রহ.) ছিলেন প্রসিদ্ধ হাশেমি বংশের একজন কৃতী পুরুষ। তার মাতা ছিলেন বাংলার মোহাদ্দেসে আযম অলিয়ে কামেল চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদের সাবেক ইমাম ও খতিব আল্লামা ছফিরুর রহমান হাশেমি (রহ.)- এর ঔরসজাত কন্যা। তার পূর্বপুরুষ সৈয়্যুদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বংশধর। তার পিতার পূর্বপুরুষ মদিনা শরিফ হতে হিজরত করে বাগদাদে আসেন। (তাদের বংশ ইমাম হাসান (রহ.)-এর সাতে মিলিত হয়)। ওখান থেকে দিল্লির বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীরের আমলে কাজীউল কুজাত বা প্রধান বিচারপতি হতে দিল্লিতে আসেন। দিল্লি থেকে নবাবি আমলে ইসলাম খাঁর অনুরোধে কাজীর দায়িত্ব গ্রহণ করে বিশেষত ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে চট্টগ্রামে তসরিফ আনেন। উল্লিখিত জীবন দেখলেই বোঝা যায় ইমামে আহলে সুন্নাত, আল্লামা কাজী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমি (মু.জি.আ.) একজন স্বনামধন্য ও চট্টগ্রামের সুন্নিয়তের মধ্যমণি গৌরব হিসেব চট্টগ্রামে হজরত মুহাম্মদ (দ.) এর বংশধরের বাণী ধারণ করে ধর্মীয় ইতিহাসে এক ধাপ এগিয়ে চট্টগ্রাম।

ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক : চট্টগ্রাম হাজার বছরের পুরনো নিজস্ব এক অনন্য ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক। নিজস্ব ভাষা, ভাষা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চট্টগ্রাম উপমহাদেশে অনন্য এক ঐতিহাসিক স্থান। উল্লেখ্য, কলকাতায় তাদের সাহিত্য সংস্কৃতি রক্ষায় গড়ে ওঠার দেড় বছর আগে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। নারী শিক্ষার বিস্তার, দেশীয় শিল্প রক্ষা, প্রথম মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপন। দেশীয় শিল্পের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিতে ১৮০০ শতাব্দীর শেষের দিকে নলিনী কান্ত সেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘জাতীয় শিল্প রক্ষিণী সমিতি’। তার প্রচেষ্টায় সেসময় ‘অধ্যয়নী সম্মিলনী’ নামে একটি পাঠাগার স্থাপিত হয়েছিল। এটাই চট্টগ্রামের প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম আসেন। ১৯২৯ সালে মুসলিম হোস্টেলের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যোগদান করতে দ্বিতীয়বার চট্টগ্রাম আসেন। সেইবার কবিকে সংবর্ধনা দিতে কাট্টলিতে ইউনিয়ন ক্লাব বিরাট সভায় আয়োজন করেছিল। ১৯৩২ সালে কবি নজরুল রাউজন সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রাম আসেন প্রধান অতিথি হিসেবে। চট্টগ্রমের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সম্প্রসারণে কবির আগমন ছিল অনুপ্রেরণাদায়ক।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হয়েছে অসংখ্য গান; যা শুধু এ অঞ্চল নয় সমাদৃত হয়েছে বিশ্বপরিমন্ডলে। সংগীত, নৃত্য, নাটক, যাত্রাপালা, কবিগান, লোক-সংগীতের চর্চা এতদঞ্চলে বরাবরই হয়ে আসছে। শিল্পে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও চট্টগ্রাম অঞ্চল শুধু বাংলাদেশের নয় উপমহাদেশের বিখ্যাত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও এ অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পাহাড়-পর্বত, নদী প্রাকৃতিক ঝরনাসহ অসংখ্য ছোট-বড় সবুজ বনানী চট্টগ্রামকে করেছে অনন্য। সুলতানি এবং মোগল আমলের বেশ কয়েকটি বড় বড় দিঘি রয়েছে চট্টগ্রামে পরাগল খাঁর দিঘি, ছুটি খাঁর দিঘি, নসরত বাদশার দিঘি, আলাওলের দিঘি, মজলিশ বিবির দিঘি, আসকার খাঁর দিঘি, হম্মাদ্যার দিঘি ইত্যাদি। এগুলো চট্টগ্রামের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে শুধু নয়, প্রাকৃতিক বিরল সম্পদও বটে। তাই চট্টগ্রামের লোক ঐতিহ্য আমাদের রক্ষা করা নৈতিক দায়িত্ব ও সময়ের দাবি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist