এম এ মাসুদ, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা)

  ২২ মার্চ, ২০২৪

সেতু ও কালভার্ট না থাকায় বিড়ম্বনা

* কন্যাশিশুর বিদ্যালয়ে যেতে অসুবিধা * বাড়ছে বাল্যবিয়ে ও জন্মহার * কৃষক পাচ্ছেন না ফসলের লাভজনক মূল্য

তিস্তা নদীর ভাঙনে সৃষ্ট নালার ওপর একটি নড়বড়ে সাঁকো। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশের রা¯ত্মায় বর্ষায় পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়া একটি স্থান পারাপার হতে বিড়ম্বনায় পড়ে এলাকার মানুষ ও স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। বর্ষাকালে পারাপারের ব্যবস্থা না থাকায় হাতে স্কুল ড্রেস ও ব্যাগ এবং পরনে গামছা পরে ওই ভাঙা জায়গাটি পার হতে হয় তাদের। অন্যদিকে নড়বড়ে ভাঙা সাঁকো পারাপারে খালে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকায় অনেক অভিভাবকই স্কুলে পাঠাতে চান না তাদের ছেলেমেয়েদের। এতে স্কুলবিমুখ হওয়ায় মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই অনেক কিশোরীকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। দুই যুগ ধরে এ অবস্থা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তারাপুর ও উলিপুরের চরের কয়েকটি গ্রামে।

জানা যায়, আশির দশক জুড়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে তিস্তা। নদীটি বয়ে চলার পথে পাড় ভেঙে একে একে বিলীন করে ফেলে বজরা, চরবিরহিম, বেকরির চর, নয়ারহাট ও ডাইরপাড়া গ্রামের দিগšত্মজোড়া ফসলি মাঠ, লোকালয়, পথঘাট ও হাটবাজার।

একসময়ে বি¯ত্মীর্ণ ওই গ্রামগুলো ছিল গাছগাছালিতে ভরা। গাছে গাছে ডাকত হরেক রকম পাখি। বাস করত নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। মাঠে ফলত সোনার ফসল। ভালোই কাটছিল সেখানকার অধিবাসীর দিন। কিন্তু পুরো আশির দশক জুড়ে ভয়ংকর তাণ্ডব চালায় সর্বনাশী তিস্তা। সবকিছু গ্রাস করে নেয় সে। সেই সঙ্গে বিলীন হয়ে যায় বজরা, চরবিরহিম, বেকরির চর, নয়ারহাট ও ডাইরপাড়া গ্রাম থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদরে যাওয়ার একমাত্র রা¯ত্মাটিও। বসতবাড়ি হারিয়ে যে যেখানে পারে ঠাঁই নেয় মাথা গোঁজার।

আশির দশকের শেষ দিকে উজানের তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের ফলে এবার শাšত্ম হয় তিস্তা। পলি জমে জেগে ওঠে চর। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অধিবাসীরা আবার ফিরতে শুর¤œ করে নিজ ভূমিতে। জেগে ওঠা চরে ফলাতে শুর¤œ করেন ধান, পাট, ভুট্টা, গম, আলু, বেগুন, টমেটো, খিরা, শসা, পেঁয়াজ, রসুন, তিল, তিশি, কালিজিরা, বাদাম, ডালসহ নানা ফসল। যেদিকে চোখ যায়, শস্যে ভরা মাঠ। ভালো উৎপাদন হওয়ায় কৃষকদের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে বেশ। এখন বুঝতে পারছে তারা শিক্ষার গুরুত্ব। তাই তো কাছাকাছি স্কুল না থাকলেও সšত্মানদের পাঠান তারা দূরের ভাটিতারাপুর প্রাইমারি স্কুল, মডেল প্রাইমারি স্কুল, মীরগঞ্জ আদর্শ হাইস্কুল, পুঁটিমারি হাইস্কুল, ইমামগঞ্জ মাদরাসাসহ বিভিন্ন শিÍগাপ্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তাদের সšত্মানদের পড়াশোনায় ছন্দপতন ঘটাচ্ছে নয়ার হাটের পশ্চিমে প্রতি বছর বন্যায় ভেঙে যাওয়া কয়েক মিটার রা¯ত্মা ও ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন নালার ওপর থাকা নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোটি। ফলে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হয় শতাধিক শিক্ষার্থীকে। এমনিতে বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেলসহ নিচে পড়ে গিয়ে আহত হচ্ছেন অনেকেই। রোগী নিয়ে পড়ছেন বিপাকে। তার ওপর ভরা বর্ষায় ডুবুডুবু সাঁকো ও ভেঙে যাওয়া সড়কটির নিচু স্থানে পানিতে পড়ে যাওয়ার শঙ্কায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে দেন না অভিভাবকরা। এভাবে দীর্ঘদিন স্কুলে যেতে না পেরে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীদের অনেকেই। ফলে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই অনেক বাবা-মাই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন তাদের সšত্মানদের। এতে চরাঞ্চলে শিক্ষার হার কমে গিয়ে বাড়ছে জন্মহার।

অন্যদিকে, সেতু ও কালভার্টের অভাবে বিভিন্ন ফসল ফলাতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ বাড়ার পাশাপাশি ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। এক শিশুসšত্মানকে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছিলেন মা শিরিনা আকতার। তিনি বলেন, বর্ষায় ভেঙে যায় রা¯ত্মাটি। পানিতে পড়ে যেতে পারে এজন্য বর্ষাকালে স্কুলে পাঠান না তারা। একটি কালভার্ট করে দিলে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া সুবিধা হবে এবং ভয়ও থাকবে না বলে জানান তিনি।

স্কুলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, বর্ষায় পানিতে দুকূল ছাপিয়ে গেলে অভিভাবকরা ভয়ে স্কুলে যেতে দেন না তাদের। ফলে ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে পড়াকালীন সময়ে বিয়ে দিয়ে দেয় অভিভাবকরা। তাদের দাবি, সেতুটি করা হলে বাল্যবিয়ের হাত থেকে রেহাই পাবে তারা। বাড়বে শিক্ষার হার ও কমবে জন্মহার।

কৃষকরা বলছেন, তাদের উৎপাদিত ফসল হাটে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ সাঁকোটি। সেতুটি করা হলে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ কমবে, উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে তেমনি ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন তারা।

সংশি¯œষ্ট ওয়ার্ড মেম্বার জাহেদুল ইসলাম বলেন, বারবার মাটি দিয়ে ভরাট করলেও প্রতি বছর তিস্তার পস্নাবনে ভেঙে যায় রা¯ত্মাটির ওই একই জায়গায়। বাঁশের সাঁকোটিও টেকে না। বিশেষত বর্ষাকালে স্কুলে যেতে না পারায় বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছেন মেয়েরা। আর সরাসরি যানবাহন চলাচল না করায় ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা।

উপজেলা প্রকল্প বাত্মবায়ন কর্মকর্তা মো. ওয়ালিফ মণ্ডল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ছোট ছোট সেতু করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ভেঙে যাওয়া স্থানটিতে একটি ছোট সেতু নির্মাণে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে উপজেলা প্রকৌশলী মো. আবদুল মান্নাফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বিষয়টি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close